গত দুই দশকে অন্তত তিনবার বড় ধরণের উল্লম্ফন ও ধস সৃষ্টি করে দেশের পুুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে সরে পড়েছে ঈদশি-বিদেশি চক্র। এরপর দীর্ঘ খরা কাটিয়ে দেশের পুঁজিবাজারে আবারো আশার আলো ঈদখা যাচ্ছে। করোনা মহামারীর বাস্তবতায় দেশীয় বিনিয়োগে এক ধরণের স্থবিরতা দেখা গেলেও করোনাত্তোর নতুন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শুরুতে চলতি বছরের প্রথম দিকে দেশের পুঁজিবাজারের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেছিলেন, ২০২১ সালে দেশের পুঁজিবাজার একটি শক্তিশালী বাজারে পরিনত হবে। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের সেই ভবিষ্যদ্বানির বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে এখন। গত সোমবার ঢাকা স্টক এক্সেঞ্জে ২ হাজার সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। অধিকাংশ শেয়ারের দাম কমে মূল্য সূচক ২৮ পয়েন্ট নিচে নেমে গেলেও লেনদেন বেড়েছে আগের দিনের চেয়ে ৩১৬ কোটি টাকার বেশি। একই প্রবণতা দেশের দ্বিতীয় শেয়ার বাজার সিএসইতেও দেখা গেছে। শেয়ার বাজার সমূহের বর্তমান অবস্থা ও গতিপ্রকৃতিকে খুবই ইতিবাচকভাবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।
সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, পুঁজিবাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারিদের আস্থার সংকট কাটতে শুরু করেছে। এক সময় হাজার হাজার বিনিয়োগকারি তথা বিও অ্যাকাউন্ট অকেজো হয়ে পড়ার কথা বলা হলেও চলতি বছরে নতুন বাস্তবতায় পুঁজিবাজারে ২৭ হাজার নতুন বিনিয়োগকারির সংযোগ ঘটেছে বলে জানা যায়। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেছেন, কেউ কেউ বাস্তবতার বাইরে গিয়ে শেয়ারবাজারকে অতিমূল্যায়িত বলে মন্তব্য করেন। বাস্তবে শেয়ারবাজার অতিমূল্যায়িত না। তাই শেয়ার বাজার নিয়ে আতঙ্ক না ছড়ানোর জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলা বাহুল্য, শেয়ার বাজারের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে কেউ কেউ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কেউ কেউ সূচক দেখে শেয়ারবাজারকে অতিমূল্যায়িত বলে মন্তব্য করছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান সবাইকে আশ্বস্থ করে এই বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি আশার কথা বলেছেন। এটি ইতিবাচক দিক। অস্বীকার কারার উপায় নেই, করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা, কর্মসংস্থানের সংকট হাজার হাজার মানুষকে বেকারত্বের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অনেকে আয়-রোজগারের জন্য শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। আশা নিয়ে তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে এসেছে। ফলে তাদের পুঁজির নিরাপত্তা যেনো কোনো কারসাজিমূলক সিন্ডিকেটের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা জরুরী। পুঁজিবাজার সম্পর্কে নতুন বিনিয়োগকারিদের সচেতনতাও থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিএসইসি, ডিএসই, সিএসইসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও অরিয়েন্টেশন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। কোনো পক্ষের গুজব বা আতঙ্ক ছড়িয়ে ফায়দা হাসিলের যেকোনো অপপ্রয়াস সম্পর্কে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। সোমবার শুরু হওয়া বিশ্ব বিনিয়োগকারি সপ্তাহের উদ্বোধনী দিনে বিএসএইসি’র নিজস্ব ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ছিল, রোল অব সাসটেইনেবল ফিন্যান্স অ্যান্ড ফ্রড অ্যান্ড স্কাম প্রিভেশন ইন প্রটেক্টিং দ্য ইন্টারেস্ট অব ইনভেস্টার্স এন্ড ইনভেস্টার্স অ্যাওয়ারনেস’। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারিদের স্বার্থরক্ষায় বিএসইসি’র এমন উদ্যোগ বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও বাজার স্থিতিশীলতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের শিল্প বিনিয়োগে সাধারন মানুষের অর্থ লগ্নি করার সহজ মাধ্যম হচ্ছে পুঁজিবাজার। পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে লাখ লাখ বিনিয়োগকারির স্বার্থ রক্ষার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল বিনিয়োগাকারিদের মধ্যে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বিনিয়োগকারি ও বাজার সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকতে হবে। হুজুগে বা গুজবের কারণে বাজার অতিমূল্যায়িত হলে ধস নামার আশঙ্কা থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই বুঝে শুনে বিনিয়োগ করা উচিৎ। এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, পুঁজিবাজারে ধস নামলে তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাদের হক নষ্ট হয়। হক নষ্ট করা মহাপাপ। হক নষ্টকারীদের আল্লাহও ক্ষমা করেন না। কাজেই লাখ লাখ দরিদ্র বিনিয়োগকারীর পুঁজি যাতে খোয়া না যায়, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও গতি ধরে রাখতে হবে। যারা এর স্থিতিশীলতা নষ্টের অপচেষ্টা করবে তাদের প্রতিহত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালার পরও দেশে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থাপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে পারলে তা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করতে পারে। এ প্রেক্ষিতে, বিনিয়োগের নতুন খাত এবং ভাল মানের শেয়ার বন্টনের অনুকূল পরিবেশ তৈরীর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কৃত্রিমভাবে বাজার চাঙ্গা করে নিম্নমানের শেয়ারের অতিমূল্যায়ণের যেকোনো প্রবণতা রোধে শুরুতেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যেন কোনো সিন্ডিকেট দরিদ্র সাধারণ বিনিয়োগকারিদের হক নষ্ট করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন