শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভোটাধিকার অর্জনে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের বিকল্প নেই

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

দীর্ঘ একযুগ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে অভিযুক্ত এ সরকার জনগণের আস্থায় নেই বললে অযৌক্তিক হবে না। সরকার যদি জনগণের আস্থায় থাকত তবে গণহারে ‘গায়েবি’ মোকদ্দমা সৃজন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাধ্য করত না। দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগে সরকারকে অভিযুক্ত হতে হতো না। সরকারি প্রভাবমুক্ত একটি জাতীয় নির্বাচনের জন্যই যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পরই নিরষ্কুশ ক্ষমতাবলে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রভিশন বাতিল করে দেয়। এ জন্য ক্ষমতাসীন দল সাবেক প্রধান বিচারপতি, এ বি এম খায়রুল হককে ব্যবহার করেছে বলে সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় গণতন্ত্র হত্যার অভিযোগে তার বিচার দাবি করা হয়েছে।

গণমানুষের ভোটাধিকারের দাবিতেই স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের ভোটের রায় যদি মেনে নিত তবে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রয়োজন হতো না। স্বাধীনতার পর জাতি একটি সংবিধান পেয়েছে, নিশ্চয়তা পেয়েছে মৌলিক অধিকারের, যা এখন শুধু কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ। গণমানুষ সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। একদিকে বিরোধী দলগুলো অহেতুক মামলা মোকদ্দমাসহ নানাবিধ নির্যাতনের শিকার, অন্যদিকে মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ এবং আমলা শ্রেণী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কারণে রাজনৈতিক তথা ভোটাধিকারের হাওয়া যেভাবে প্রবাহিত হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হচ্ছে না।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। যথা: ১. ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। ২. বাম ধারার রাজনীতি। ৩. মধ্যপন্থী বা উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতি। ৪. ক্ষমতার রাজনীতি। ৫. তৃতীয় স্রোত।

১. ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ইসলামিক শাসনতন্ত্রভিত্তিক সরকার গঠনে বিশ্বাসী। মিছিল মিটিংয়ে তারা অনেক লোকের সমাবেশ করতে পারে, কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধ নয়। একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে কঠিন ভাষায় সমালোচনা করে, যতটুকু না তারা সরকারের বিরুদ্ধে করে। হেফাজত একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, কিন্তু সোনারগাঁ রিসোর্ট কেলেঙ্কারিতে ধরাশায়ী হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী কর্মীভিত্তিক একটি সু-সংগঠিত দল। চেইন অব কমান্ড তাদের অনেক দৃঢ়। কর্মীদের পড়াশোনা আছে, রয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানচর্চা। কিন্তু স্বাধীনতার প্রশ্নে বিতর্কিত কর্মকান্ড তাদের পিছু টানছে, যদিও গ্রেফতার হওয়া অনেকের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জন্মই হয়নি। জামায়াতে ইসলামীকে সরকার ন্যূনতম ছাড় দিচ্ছে না। যে কোনোভাবেই তাদের পোষ মানানোই এখন টার্গেট হতে পারে। খুঁজে খুঁজে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দিচ্ছে। বিচারিক সিদ্ধান্ত তাদের অনুক‚লে হয় না। স্বাধীনতার বিষয়টি সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী থেকে বেরিয়ে এসে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ (এবি পার্টি) গঠিত হয়েছে। কিন্তু দেশব্যাপী পরিচিত নেতা না থাকার কারণে দলটি কতটুকু এগোতে পারবে বোঝা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেকেই ওই দল ত্যাগ করে কল্যাণ পার্টিতে যোগ দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে দুই ধারার রাজনীতি দেশবাসী গ্রহণ করবে না, যথা: ১. স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতি ও ২. ধর্মবিমুখ বা ধর্মবিরোধী রাজনীতি। কারণ এ দেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মভীরু। তবে বুদ্ধিজীবী অঙ্গনে নাস্তিকের সংখ্যা মোটেও কম নয়, বিশেষ করে কলকাতামনস্ক বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই এই গোত্রভুক্ত। উগ্রপন্থী রাজনীতিও দেশবাসী সমর্থন করে না। বাম ধারার রাজনীতি জনগণের মধ্যে এখনো ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারলেও আন্দোলন সংগ্রাম ও গণমানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে সক্রিয়। তবে এরা বিভিন্ন ধ্যান ধারণায় বিভক্ত। কোনো কোনো বিষয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ হয় বটে, যা ইসলামিক দলগুলো হতে পারে না। ধর্মভিত্তিক দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারত তবে সরকারের খুঁটি কাঁপানোর ক্ষমতা তারা রাখে, এ কথা প্রমাণিত। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ নেতা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তারা কেউ কাউকে মানতে পারছে না। ফলে ইসলামী ঐক্যের আন্দোলন ভেস্তে যাচ্ছে, যার ফয়দা লুটে নিচ্ছে সরকার।

৩. বাংলাদেশে অনেক উদারপন্থী বা মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল রয়েছে, যারা নেতাসর্বস্ব। উদারপন্থী গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে বিরোধী অবস্থানে বিএনপি একটি গণভিত্তিক দল। গ্রামগঞ্জে দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ দলের একটি ব্যাপক পরিচিতি ও সমর্থক রয়েছে। এ দলের কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য তৃণমূল পর্যায়ে এখনো দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। সরকারের নানাবিধ নির্যাতন তৃণমূলে দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করতে পারেনি। উপরের স্তরে কিছু ভিন্নতা আছে, দলের সুবিধা ভোগ করেও এই দুঃসময়ে পদত্যাগ বা নিষ্ক্রিয় রয়েছে। পুলিশি নির্যাতন ছাড়াও গ্রামগঞ্জে এমপি বাহিনী দ্বারা বিএনপি নেতাকর্মীরা নির্যাতিত। ডান-বাম ২০টি শরিক দল নিয়ে বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তাতে বিএনপির মতো একটি বড় দল লাভবান হয়নি, লাভবান হয়েছে ড. কামাল হোসেন ও সরকার। প্রধানমন্ত্রীর সাথে নির্বাচনপূর্ব সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি জোরালোভাবে চায়নি। একজন খ্যাতনামা আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল একদিনের জন্যও হাইকোর্ট বা অ্যাপিলেট ডিভিশনে বিএনপির চেয়ারপারসনের মুক্তির জন্য শুনানিতে অংশগ্রহণ করেননি অথবা তাঁর উপস্থিতিতে সংলাপ করার দাবিও করা হয়নি। বরং ড. কামালের কিছু বক্তব্য বুমেরাং হয়েছে। নির্বাচনে পাস করলে কে হবে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী, এ মর্মেও ঐক্যফ্রন্ট কোনো প্রকার ঘোষণা দিতে পারেনি, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনের অপরিহার্য বিষয়। ঐক্যফ্রন্ট করে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কতটুকু লাভবান হয়েছে তাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে, বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির স্বার্থে। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারবিরোধী যেকোনো সমাবেশে উপস্থিত হয়ে সরকারের কঠিন সমালোচনা করেন, যা জনমত গঠনে সহায়ক, কিন্তু সম্প্রতি তার কিছু অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যে দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি থেকে দূরে সরে পড়েছেন। এতে তিনি লাভবান হননি, বরং লাভবান হবে সরকার।

৪. বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতির মজা ভিন্নতর। যেকোনো সরকার ক্ষমতায় গেলে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রয়োজন মনে করে না। দলে প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী গড়ে তোলে না। তখন সরকারের মূলশক্তি হিসেবে মূল্যায়িত হয় আমলা ও এমপি। এমপি ও আমলার মধ্যে বিরোধ বাঁধলে সরকার আমলাদেরই পক্ষ নেয়। এখন সরকার বুঝতে পেরেছে, ক্ষমতায় থাকতে হলে লোকদেখানো জাতীয় সংসদ থাকতে হয় বটে, কিন্তু আমলা ছাড়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সম্ভব হয় না। তাছাড়া জনগণের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার পদদলিত করে বিরোধী দলের মুখ বন্ধ রাখার নানা কূটকৌশল একমাত্র আমলাদের হাতেই রয়েছে। ফলে গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরার জন্য আমলারাই শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। আমলাদের সব অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ড সমর্থন করার জন্য রয়েছে সরকারি আশীর্বাদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা। একটি সত্যনিষ্ঠ কথা বললেও বুদ্ধিজীবীরা সেখানে সা¤প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে মূল ঘটনাপ্রবাহ থেকে জনগণকে সরিয়ে আনে। বাংলা একাডেমির মতো একটি নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক বুদ্ধিভিত্তিক জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে সরকারি আশীর্বাদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা দখল করে রেখেছে। বাংলা একাডেমির সদস্যদের দ্বারা একটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা বাংলা একাডেমি পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও সরকার নিযুক্ত কমিটি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে সরকারবিরোধী কোনো লেখকের লেখা বই ছাপানোর দায়িত্ব বাংলা একাডেমি গ্রহণ করে না। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া সরকার করায়ত্ত করে ফেলেছে। অধিকন্তু রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮। জাতীয় প্রেসক্লাব এখন সরকার ঘরানার সাংবাদিকদের দখলে। বুক পকেটে ৩-৪টি কলম, কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ এবং খদ্দর কাপড়ের পাঞ্জাবি গায়ে দেখে আগের মতো এখন বুদ্ধিজীবী চেনার উপায় নেই। কারণ তারা এখন বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে, যার পেছনে রয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে জনগণের মৌলিক অধিকারের পক্ষে কথা না বলে নিজেদের ও পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন নিয়েই সচেষ্ট রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভিন্নতর কিছু থাকলেও তা সংখ্যার দিক থেকে নগণ্য।

৫. বাংলাদেশে ৪৭টি নিবন্ধনকৃত দল রয়েছে। নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে আরো ১৫ থেকে ২০টি দল। তৃতীয় স্রোতের রাজনীতি শুরু করার জন্য সুশীলসমাজ সচেষ্ট রয়েছে। সম্ভাবনাময় ছাত্রনেতা ডাকসুর সাবেক ভিপিকে এই তৃতীয় স্রোতের মুখপাত্র হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো বিকল্প পরিবেশ পরিস্থিতি ছাড়া বড় ধরনের রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠা কতটুকু বাস্তব? কেউ বলেন, জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তিই ক্ষমতার উৎস, কেউ বলেন, অন্য কথা। কোনটা সত্য তা সময়ই বলে দেয়।

বাংলাদেশে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ সবচেয়ে বড় সমস্যা। ব্যুরোক্র্যাসির কু-এর কারণে জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ বলেছিলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো এত সুন্দর নির্বাচন তিনি দেখেননি। পুলিশ প্রধান ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার অনুরূপ মন্তব্যই করেন। সরকারি দলের মুখপাত্র বলেন, ভবিষ্যতে আরো সুন্দর নির্বাচন হবে। এখন জনগণ বলতে পারবে যে, কতটুকু সুন্দর নির্বাচন হয়েছে। শতকরা কতজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। গায়েবি মোকদ্দমায় আসামি হয়ে কতজন কারাবন্দী ও বাড়িঘর ছাড়া ছিলেন। এ কথা বিবেককে সাক্ষী রেখে জনগণকে বলতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, যেমন- ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে, তেমনি ভোটাধিকার বাস্তবায়নের দাবিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। জাতীয় কোনো সঙ্কটে বিদেশি শক্তি বা রাষ্ট্র বিবেচনা করে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ, আর জাতিসঙ্ঘ প্রকাশ করে উদ্বেগ; ফলে জাতিকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হবে। ভোটাধিকার সঙ্কট যদি আশু সমাধান না হয় তবে ২০২৩-এর জাতীয় নির্বাচন ২০১৮-এর মতোই হবে। জনগণ, ভোটার ও বিরোধী দলকে থাকতে হবে বহুদূরে। ফলে জাতি হবে আশাহত, স্বাধীনতার চেতনা হবে ভূলুষ্ঠিত।

লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন