‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন/ কান্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সারাজীবন হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির গান গেয়েছেন। আবহমান কাল থেকে অদ্যাবধি এ দেশের মানুষ দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে চলেছে। এরপরও মাঝে মধ্যেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। এর নেপথ্যে থাকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী চক্র। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের মাধ্যমে তারা আমাদের দেশকে ধর্মীয়-সামাজিকভাবে বিভক্ত করে দুর্বল করে ভিনদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের পথ সৃষ্টি করতে চায়। বুধবার কুমিল্লার নানুয়ার দিঘিরপাড়ে শারদীয় দুর্গাপূজার মন্ডপে মূর্তির কোলে মহাগ্রন্থ আল কোরআন রেখে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অবমাননার মাধ্যমে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে কোনো কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনো নিষ্ঠাবান সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু বা সাচ্চা মুসলমানের পক্ষে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন নিয়ে এমন অবমাননাকর ভূমিকা পালন করা অসম্ভব। এমন সময় এ ঘটনা ঘটানো হলো, যখন দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা উৎসবের আমেজে নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা পালন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিতর্ক-মতভেদ সত্ত্বেও শারদীয় দুর্গাপূজায় মুসলমানরাও শুভ কামনা প্রকাশ করে সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে। সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের এই দৃষ্টান্তকে ম্লান করে দিয়ে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানকে একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে তুলে ধরতেই কোনো একটি গোষ্ঠি দূরভিসন্ধিমূলকভাবে পূজামন্ডপে কোরআন অবমাননার মতো চরম গর্হিত ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। অনতিবিলম্বে তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অবমাননা সহ্য করতে পারেন না, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য হচ্ছে কোনো কুচক্রী মহলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের দূরভিসন্ধি হাসিলের অপচেষ্টাও সফল হতে দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে ধৈর্য্য ও সহনশীলতার সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অধৈর্য্য ও আবেগতাড়িত হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজামন্ডপে হামলার মতো ঘটনা ইসলাম সমর্থন করে না। দেশে প্রশাসন আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, গোয়েন্দা বিভাগ আছে। তারা প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসবেন, এটাই সকলের প্রত্যাশা। করোনা মহামারির স্থবিরতা কাটিয়ে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এহেন পরিস্থিতিতে অবান্তর-অহেতুক সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও সংঘাতের জন্ম দিয়ে সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে পিছিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়ে থাকতে পারে। এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য কুচক্রী কুশীলবদের পাতা ফাঁদে পা না দিয়ে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সকলকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা এটিই প্রথম নয়, এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ সৃষ্টির অপচেষ্টা দেখা গেছে। মন্দিরে নাশকতা, গো-মাংস রেখে অসন্তোষ সৃষ্টির দায়ে হিন্দু যুবক ধরা পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ থেকে বোঝা যায়, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি বিনষ্টের পেছনে একটি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারী মহল সব সময়ই সক্রিয় রয়েছে। এদের মুখোশ উন্মোচন করা এখন সময়ের দাবি।
কুমিল্লার পূজামন্ডপে কোরআন অবমাননার ঘটনাকে ঘিরে সারাদেশে মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে দেশের ধর্মীয় নেতারা এ ব্যাপারে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পাশাপাশি উত্তেজনা প্রসমনে সচেষ্ট রয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা ধরনের গুজব ও উস্কানিমূলক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসংযমী-আক্রমণাত্মক আচরণ যেন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে না পারে সে দিকেও কড়া নজর রাখতে হবে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কোরআন অবমাননার প্রতিবাদ করবে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাবে এটাই স্বাভাবিক। চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে প্রতিবাদী জনতার উপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে, এতে অন্তত তিন জন নিহত হওয়ার তথ্য গতকাল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে পূজামন্ডপ ভাংচুরের খবরও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনার পেছনেও কুচক্রী মহলের ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতো অপপ্রয়াস থাকতে পারে। অতএব, সাধু সাবধান। কোরআন অবমাননাকারীদের রেহাই দেয়ার সুযোগ নেই। তবে সবকিছু হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খলভাবে। ইতোমধ্যে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও কোরআন অবমাননাকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নেপথ্যের অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোয়েন্দা বিভাগের সব প্রতিনিধিত্বশীল কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বৈঠক করেছেন। সেখানেও চক্রান্তকারী ও মূল দোষী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার এবং সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়। আর একদিন পরেই প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার মূল উৎসব শেষ হবে। উৎসব যাতে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ পূজামন্ডপগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে মুসলমান ও হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে দ্রুত ও সহজে উত্তেজনা নিরসন করা সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন