শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভারতীয় ট্রানজিটে বাণিজ্য হারাচ্ছে বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জন্য একটি ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে বিবেচিত ছিল। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ইস্যুও এর সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত বলে মত পর্যবেক্ষকদের। পক্ষান্তরে ভারতীয় ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে একশ্রেণীর বিশ্লেষক ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে এবং দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যও বিপুলভাবে লাভবান হবে বলে মত দিয়েছিল। ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার অনেক আগে থেকেই ভারতের অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার বিনা মাশুলে (পরীক্ষামূলক!) ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এই সুবিধা গ্রহণ করে বছরের পর বছর ধরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদু্যুতকেন্দ্রের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি এবং হাজার হাজার টন খাদ্যপণ্যসহ জরুরী সরঞ্জামাদি পরিবহন অব্যাহত আছে। মূলত: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত এই সুবিধা ভোগ করতে শুরু করে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় একই সঙ্গে তিস্তার পানিচুক্তি এবং ট্রানজিট চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও তিস্তা নিয়ে ভারতীয়দের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে তা’ সম্ভব না হওয়ায় রাজনৈতিক কারণে ট্রানজিট চুক্তিও হয়নি। যদিও পরীক্ষামূলক ট্রানজিট তখন থেকেই চলছে, তবে সত্তুরের দশকে পরীক্ষামূলক ফারাক্কা প্রজেক্ট চালুর মত তিস্তার পানি বণ্টনে অনুরূপ পরীক্ষামূলক উদারতা ভারতের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। গজলডোবা বাঁধের কারণে এ সময়ে পানির অভাবে তিস্তা সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভারতে সরকার পরিবর্তনের পর বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদি গত বছর জুনমাসে ঢাকা সফরে এসে বহুপ্রত্যাশিত ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বিনাশর্তেই পেয়ে যান। সেই থেকে ট্রানজিটে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতির নতুন হিসাব-নিকাশের শুরু। বস্তুত: আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি এবং অবকাঠামোখাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যিক সুরক্ষার বিষয়গুলো চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, বিশেষত: ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের ফি-নির্ধারনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ন্যূনতম স্বার্থও রক্ষিত হয়নি। যেখানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে প্রতিটন পণ্য পরিবহনে প্রায় ২০০ ডলার সাশ্রয় হচ্ছে, সময় কমছে চারভাগের তিনভাগ সেখানে ট্রানজিট ফি নির্ধারনের জন্য গঠিত কোর কমিটি টন প্রতি মাত্র ১০৫৮ টাকা ট্রানজিট ফি নির্ধারনের প্রস্তাব করেছিল। কোর কমিটির সেই প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কোন প্রকাশ্য আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ভারতীয় ট্রানজিট ফি নির্ধারিত হয়েছে টনপ্রতি মাত্র ১৯২ টাকা। বলতে গেলে বিনা মাশুলের এই ভারতীয় ট্রানজিট বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বঞ্চনার উদাহরণ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরী করা বাংলাদেশের রাস্তা, বন্দর ও অবকাঠামো ভারতীয় ট্রানজিটের ট্রেইলারের চাকায় নষ্ট হয়ে গেলেও ন্যূনতম মাশুলও পাচ্ছে না। অন্যদিকে ট্রানজিটের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের বিদ্যমান বাণিজ্যও এখন চরমভাবে মার খেতে শুরু করেছে।
গত বুধবার ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে চলমান রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। এমনিতেই ট্যারিফ ও ননট্যারিফ ব্যারিয়ার সৃষ্টি করে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করে বাণিজ্য বৈষম্য বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এমতাবস্থায় ভূ-রাজনৈতিক কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যৎসামান্য পণ্য রফতানির সুযোগ পাচ্ছিল বাংলাদেশের রফতানিকারকরা। ট্রানজিটের কারণে অবশেষে তাও বন্ধ হতে চলেছে। ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার আগে যেখানে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ৪০ প্রকারের রফতানি পণ্য নিয়ে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টি ট্রাক ভারতে যেত, সেখানে এখন তা’ দশভাগের একভাগে নেমে এসেছে। এখন দিনে সর্বোচ্চ ১০-১৫টি ট্রাক পাথর নিয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যায়। অথচ ভারতীয় ট্রানজিটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে গিয়েও বাংলাদেশের নৌপারিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ট্রানজিটে বাংলাদেশের অনেক সুবিধা হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন। এক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মশিউর রহমান ট্রানজিটের নামমাত্র ফি সম্পর্কে সমালোচনাকারিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তাদের বোঝা উচিৎ ট্রানজিট আঞ্চলিক বাণিজ্যকে চাঙ্গা করবে। যেখানে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বিনাশুল্কে প্রতিদিন শত শত টন মালামাল ভারতের অন্যপ্রান্ত থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পাঠাতে পারছে, সেখানে তারা বাংলাদেশ থেকে কেন পণ্য কিনতে যাবে? এই সরল হিসাবটি বুঝতে আমাদের সরকারের নীতি-নির্ধারকরা নিশ্চয়ই অক্ষম নন। ভারতীয়রা এতদিন যেভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে পণ্য পরিবহন করত, বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধার ফলে টনপ্রতি কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা খরচ, সময় ও ঝুঁকি কমে যাওয়ার পরও ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশকৃত মাত্র ১০৫৮ টাকা ট্রানজিট ফি’র প্রস্তাব কি করে ১৯২ টাকায় নেমে গেল তা’ বোধগম্য নয়। যদিও বাংলাদেশের রাস্তা ও অবকাঠামো এখনো ভারতীয় ট্রানজিটের উপযুক্ত নয়, উপরন্তু নামমাত্র শুল্কে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে ধস নামানোর আত্মাঘাতী কাজটি করা হয়েছে। ভারতীয় ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যু। শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিবেচনায় এ ধরনের ট্রানজিট হতে পারে। ট্রানজিটের শুল্কহার যদি বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা’ পুন:নির্ধারনের দাবি রাখে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন