শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ কী?

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০২ এএম

রোহিঙ্গা সংকট সমাধান আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। মানবিক কারনে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। শীঘ্রই প্রত্যাবাসন শুরু হবে, এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। চলতি বছর (২০২১) ১৯ জানুয়ারির বাংলাদেশ, মিয়ানমার আর চীনের পররাষ্ট্র সচিবদের অংশগ্রহণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ত্রিপক্ষীয় সংলাপ (ভার্চুয়ালি) হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে আর কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। দিন যত যাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট ক্রমেই জটিল হচ্ছে। ভাসানচর ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শরণার্থী কিশোর, তরুণ ও তরুণীরা বড় হচ্ছে, শিশু জন্ম হারও বেড়েই চলেছে। ফলে তাদের জীবনের নানা চাহিদাও তৈরি হচ্ছে। তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি ও ব্যবসা বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্তির বিষয়গুলোর ঘাটতি আশ্রয় শিবিরে পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।

মাদকাসক্তিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী কিশোর, তরুণ শিক্ষার সুযোগ না পেলে এবং কর্মক্ষম নর-নারী কাজ করতে না পারলে, বছরের পর বছর অলস জীবন যাপন করলে তাদের মধ্যে হতাশা, স্বাস্থ্যহীনতা, অপরাধ প্রবণতা, মাদকাসক্তিসহ নানা অপরাধ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। যা অত্র অঞ্চলের আর্থসামাজিক ও পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে। গত ২৫ আগস্ট ২০২১ রোহিঙ্গা গণহত্যার চার বছর পূর্ণ হলেও প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কূটনৈতিক কোনো অগ্রগতি হয়নি। পুরনো ও নতুন মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের মানবিক সহায়তার উপরে নির্ভরশীল। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ও তার জনগোষ্ঠী। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের কারণে সংকট আরও জটিল হচ্ছে। প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

মিয়ানমার সেনাদের গণহত্যা থেকে জীবন রক্ষার্থে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। তাদের প্রত্যাবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি। মিয়ানমার এ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বা নেয়ার চেষ্টা করছে এমন কোনো তথ্য পত্র পত্রিকা বা মিডিয়ার খবরে জানা যায়নি। নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি না হলে শরণার্থীরা তাদের দেশে ফেরত যেতে রাজি হবে না। তাছাড়া জোর করেও ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। রাখাইনে পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় ও নাগরিকত্বসহ রোহিঙ্গাদের দেওয়া শর্তগুলো পূরণ না হওয়ায় ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের যে তারিখ ছিল তা ব্যর্থ হয়। চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবসানের তারিখ ঠিক করলেও রাখাইনের পরিবেশ অনুকূল না থাকায় শরণার্থীরা তাদের দেশে ফেরত যেতে রাজি হয়নি। কূটনীতিকরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি না করে বরং বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নানা পরামর্শ দিচ্ছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে যে মহানুভবতা ও মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও প্রভাবশালী দেশসমূহ যতটা যৌক্তিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ দেখানো উচিত তার অনুপস্থিতির পাশাপাশি শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এযাবৎ চীনের অবস্থান হতাশা ব্যাঞ্জক। পাশাপাশি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পক্ষ থেকেও সংকট সমাধানের সহায়তামূলক কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। মিয়ানমার অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে চীনের উপরে নির্ভরশীল, কিন্তু চীনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিয়ানমারের উপর নির্ভরশীল। সমস্যা সমাধানে তাই শুধু চীনের উপর নির্ভর উচিত হবে না বলে কূটনীতিকরা মনে করেন।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি যেন আড়ালে না পড়ে সে দিকে আমাদের কূটনীতিকদের লক্ষ রাখা উচিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশে জাতিসংঘ, শরণার্থী সমস্যাসহ নানা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদের মতৈক্যের উপর নির্ভর করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের মতৈক্যের অভাবে বিশ্বের অনেক সমস্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সংকটও তার বাইরে নয়।

বিশ্বে বর্তমানে প্রায় আড়াই কোটির বেশি শরণার্থী আছে। এর প্রায় ৮০ শতাংশই উন্নয়নশীল দেশে আশ্রয় পেয়েছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি এ শরণার্থী সমস্যা বড় ধরনের সমস্যা হিসাবে যুক্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক জাতিসংঘ, শরণার্থী সংস্থা, ইউএনএইচসিআরের তথ্যের উপর ভিত্তি করে যে রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেম ওয়ার্ক (আরপিআরএফ) তৈরি করেছে। তাতে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা ৫৯ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়া প্রস্তাব করেছে। এ প্রস্তাবের পেছনে যে শর্ত ও উদ্দেদশ্য রয়েছে তা নিয়ে কূটনীতিক মহলে না প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে শরণার্থীদের স্থায়ীভাবে আত্তীকরণের বিষয়টি নিয়েও।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ্ হত্যাকান্ডের বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সম্পদ্রায়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে শান্তিপূর্ণভাবে ফেরত যাওয়া যত দীর্ঘ হবে রোহিঙ্গা শিবিরে নানা সমস্যা হানাহানি, গ্রুপিং, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকাও তত বাড়বে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি কূটনীতিকভাবে রোহিঙ্গাদের নিজদেশে প্রত্যাবাসন ইস্যু নিয়ে সদা জাগ্রত থাকতে হবে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৭৬তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাশন নিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব। এ জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানান। এর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী হতাশা প্রকাশ করেন।

সে সময় রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে পাঁচটি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবগুলো ছিল: ১. অবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারের সহিংসতা ও জাতিগত নিধন নিঃশর্ত বন্ধ করা। ২. অবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা। ৩. জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা। ৪. রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘর বাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিতকরা। ৫. কফি আনান কমিশেনের সুপারিশ মালার নিঃশর্ত পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন। প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানের কোনো সাড়া আজও পাওয়া যায়নি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের সামনে এখন রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘ মেয়াদি সমাধানে জোর দেয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা সংকট দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি। বিষয়টি আরো জোরালোভাবে আন্তর্জাতিক সম্পদ্রায়ের সামনে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি বিষয়টি সমাধানে এককভাবে চীনের উপর নির্ভর না থেকে জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

সংকট সমাধানের জন্য বিকল্প উপায়ের কথাও চিন্তা করতে হবে। প্রথমত রাখাইনে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করা, দ্বিতীয়ত তৃতীয় কোনো দেশে তাদের পুনর্বাসনের জন্য কূটনৈতিক চেষ্টা অব্যহত রাখা। বিশ্বের যে দেশে জনসংখ্যা কম, আর্থিকভাবে উন্নত সেসকল দেশে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কথা ভাবতে হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এতো সহজে হবার নয়। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে বিপুল সংখ্যক তরুণ বড় হচ্ছে তাদেরকে কোনো কাজে না লাগালে তারা বড় ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে অত্র অঞ্চলের সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা আরও প্রকট হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি, কারখানা, গার্মেন্টস, স্থাপন করে তাদেরকে কাজের মধ্যে রাখার বিষয়টি আইনগতভাবে দেখা উচিত। পাশাপাশি পত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি কূটনৈতিক চেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত।

লেখক: অর্থনীতিবিদ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন