শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পরিবেশ বাঁচাতে কাগজের রিসাইক্লিং

আশিক মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৭ এএম

কাগজ রিসাইক্লিং হচ্ছে কাগজ পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রক্রিয়া, যার দ্বারা বর্জ্য কাগজ নতুন কাগজে রূপান্তরিত হয়। পুরাতন বা বর্জ্য কাগজকে নতুন কাগজের পালপের সঙ্গে মিশিইয়ে নতুন কাগজ উৎপাদন করার প্রক্রিয়াকে কাগজ রিসাইক্লিং বলে। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া ঢেউখেলানো পত্র, পুরাতন ম্যাগাজিন, পুরনো খবরের কাগজ, অফিসের কাগজ এবং বাসায় ব্যবহৃত অন্যান্য কাগজ হতে এই রিসাইক্লিং করা হয়।

মূলত ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর এদেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কাগজ শিল্পের বিকাশ ঘটে। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে ৩টি কাগজ কল ছাড়াও বেসরকারি মালিকানাধীন ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি পেপার মিল রয়েছে। আর দেশেই উৎপাদন হচ্ছে উন্নত মানের কাগজ। দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে কাগজ রপ্তানিও করছে বাংলাদেশ।

কম্পিউটারের এই যুগে কাগজের ব্যবহার কমার বদলে বেড়েই চলেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর। হারিয়ে যাচ্ছে বনজঙ্গল, বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। ১৯৫০ সালের তুলনায় আজ কাগজের ব্যবহার প্রায় ৭ গুণ বেড়ে গেছে। সেই কাগজের যোগান দিতে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বনজঙ্গল, যা টিউনিশিয়ার মতে দেশের আয়তনের প্রায় সমান। বেড়ে চলেছে এমন সব গাছপালার প্লান্টেশন বা বাগান, যা দিয়ে কাগজের মণ্ড তৈরি করা যায়। অথচ গাছের কাঠ থেকে নতুন কাগজ তৈরি না করে পুরানো কাগজের রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহার করলে পরিবেশের অনেক কম ক্ষতি হয়। ১৯৮০-র দশকে যখন ইন্টারনেট ও ই-মেলের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তখন সবাই মনে করেছিল, এবার হয়তো অফিস-আদালতে কাগজের ব্যবহার অনেক কমে যাবে অথচ বাস্তবে তেমনটা হয়নি।

এই পরিস্থিতি যে নিছক আনুমানিক নয়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ইউরোপে চালানো এক সমীক্ষা, যার পোশাকি নাম ‘ইন পেপার উই ট্রাস্ট’ অর্থাৎ কাগজের উপরেই আমাদের আস্থা রয়েছে। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ করা সত্ত্বেও অনেকেই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে তার একটা প্রিন্ট নিয়ে রাখেন। আরও দেখা গেছে, যে অর্থনৈতিক সংকট ঘটলে কাগজের চাহিদা কমার বদলে বেড়ে যায়। গোটা বিশ্বে ৪টি দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও জার্মানিতে কাগজের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। জার্মানিতে কাগজ ব্যবহারের মাথাপিছু বাৎসরিক হার প্রায় ২৩০ কিলোগ্রাম, যা গোটা বিশ্বের গড় হারের তুলনায় প্রায় ৪ গুণ বেশি। জনসংখ্যার বিচারেও এই প্রবণতা বিস্ময়কর।

বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, মুদ্রণ ও প্যাকেজিং শিল্পে ব্যবহৃত উন্নতমানের কাগজ এখন বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। দেশি কাগজকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা দেশের মোট চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। দেশে উৎপাদিত কাগজ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ প্রিন্টং প্রেসসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে দেশের কাগজ। বিগত অর্থবছরও ১৬৮ কোটি টাকার কাগজ রপ্তানি করেছে মিলগুলো।

অপরিকল্পিত লাগামহীন কাগজ উৎপাদনের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে এবং রিসাইক্লিংয়ের প্রতি উৎসাহী হতে হবে। কেননা কাগজ উৎপাদনের জন্য কাঠ ও বাঁশ প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে সরাসরি পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। কাগজ তৈরির জন্য কাঠের বেড়ে চলা চাহিদার পরিণাম ভয়াবহ। কাঠের অন্যান্য ব্যবহারের সঙ্গে এই বাড়তি চাহিদা যোগ হওয়ার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বনাঞ্চল। তাছাড়া শুধু যে গাছ কাটা হচ্ছে তাই নয়, সেইসঙ্গে জঙ্গলের স্বাভাবিক গাছপালা ধ্বংস করে খালি জায়গায় লাগানো হচ্ছে শুধু এমন সব গাছ, যা দ্রুত বেড়ে উঠবে এবং যা থেকে কাগজ তৈরির উপযোগী তন্তু পাওয়া যাবে। তাই কাগজ উৎপাদন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের অন্যতম কারন হয়ে দাঁড়াবে। এভাবে চলতে থাকলে বনাঞ্চল থেকে গাছপালা দিন দিন কমতে থাকবে। তাই কাগজ রিসাইক্লিংয়ের প্রতি আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। কেননা কাগজ রিসাইক্লিংয়ের রয়েছে নানা পরিবেশগত উপকারিতা, পাশাপাশি যেহেতু পুরাতন কাগজ থেকে নতুন কাগজ উৎপাদন করা জাচ্ছে সেক্ষেত্রে কাঁচামাল ক্রয়ের খরচ কমে আসবে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত ৬৫.৪ শতাংশ কাগজ পুনর্ব্যবহারের জন্য উদ্ধার করা হয়, মোট ৫১ মিলিয়ন টন। আমেরিকান ফরেস্ট ও পেপার অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী, ১৯৯০ সাল থেকে পুনরুদ্ধারের হারে ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রথমত পুরাতন কাগজ সংগ্রহ করা, হতে পারে তা খবরের কাগজ, অফিসের কাগজ, ম্যাগাজিন এবং বাসায় ব্যাবহার করা কাগজ। কাগজ রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য কাগজকে প্রকার ও গ্রেডে পৃথক করা প্রয়োজন। পুরনো কাগজকে প্রথমে ডি-ইংকিং বা কালি বিমোচন পদ্ধতি দ্বারা কাগজের কালি বিমুক্ত করা হয়। কালি বিমুক্ত কাগজকে পানিসহ পযড়ঢ়ঢ়বফ করা হয় এবং উক্ত মিশ্রণকে উত্তাপ দেওয়া হয়। এতে লিগনিনের গঠন ভেঙে যায় এবং পাল্প তৈরি হয়। স্ক্রিন দ্বারা পাল্প থেকে আঠা অথবা প্লাস্টিক ও অন্যান্য পদার্থ আলাদা করা হয়। বিরঞ্জিত করার পর পানিতে মেশানো হয় এবং পরে শুকানো হয়। আর এই পাল্প দিয়েই নতুন কাগজ তৈরি করা হয়।
প্রথমত কাগজ তৈরি করতে হয় কাঠ থেকে। এক টন খবরের কাগজ রিসাইকেল করলে প্রায় এক টন কাঠ বেঁচে যায়, প্রিন্টেড কাগজ রিসাইকেল করলে প্রায় দুই টন কাঠ সাশ্রয় হয়। কাগজ তৈরিতে যে পরিমাণ পানি দূষণ ঘটে কাগজ রিসাইক্লিংয়ে অতটা ঘটে না। কাঠ হতে কাগজ তৈরি করতে প্রচুর জ্বালানির খরচ হয়, কিন্তু রিসাইক্লিংয়ের ক্ষেত্রে জ্বালানি ৪০-৬০% কম লাগে। নতুন কাগজ উৎপাদনের তুলনায় কাগজ রিসাইক্লিংয়ের পানি দূষণ ৩৫% কম এবং বায়ু দূষণ ৭৪% কম ঘটে। ইউরোপে ব্যবহৃত কাগজের ৬০% রিসাইকেল হয়। পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাগজ প্রাকৃতিক সম্পদগুলি রক্ষা করে, শক্তি সঞ্চয় করে, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে। এক টন পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাগজ ১৭টি গাছ, ৭,০০০ গ্যালন পানি, ৩৮০ গ্যালন তেল, ৩২ কিউবিক ইয়ার্ড ল্যান্ডফিল স্পেস এবং ৪,০০০ কিলোওয়াট শক্তি-যথেষ্ট পরিমাণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছয় মাস ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে পারে। পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য দেশে কাগজের ব্যবহার রয়েছে। কাগজ ছাড়া সভ্যতাকে কল্পনাও করা যায় না। কাগজ যেমন একটি সম্ভাবনাময় শিল্প তেমনি নষ্ট বা অপচয়ক্রিত কাগজগুলোর রিসাইক্লিং কাগজ শিল্পকে আরও প্রসারিত করবে। পাশাপাশি কমিয়ে আনবে কাঁচামাল প্রাপ্যতার চাপ এবং কাগজ উৎপাদনের খরচ। সেই সাথে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়া হ্রাস পাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন