স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই ৫০ বছরে দেশের উন্নয়ন লক্ষণীয় এবং প্রশংসনীয়। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে সরে এখন আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে জায়গা করে নিচ্ছি। এই যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না। সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্জনের খাতায় আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যুক্ত হয়েছে, তা হচ্ছে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে বিশ্বে এগিয়ে থাকা ৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। যেখানে অনেক উন্নয়নশীল দেশই এসডিজি অর্জনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেখানে মহামারীকালেও বাংলাদেশের এই অর্জন অভাবনীয়।
জাতিসংঘ ২০০০-২০১৫ সালে ১৫ বছর মেয়াদি একটি লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করে, যা সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি নামে পরিচিত। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল প্রশংসনীয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ১৫ বছর মেয়াদি আরো একটি লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়, যার প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১৭টি উল্লেখযোগ্য ও সময়োপযোগী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে দারিদ্র্যতা দূর করা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য, উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত ও লিঙ্গবৈষম্য প্রতিরোধ অন্যতম। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এসডিজির ১৭টি গোল বা লক্ষ্য হলো: দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষ্টির প্রসার, সবার জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ, সবার জন্য শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা অর্জন ও নারী ক্ষমতায়ন, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা, সহজলভ্য জ্বালানি, সবার জন্য কর্মসংস্থান ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, অন্তঃ ও আন্তঃ দেশীয় অসমতা কমিয়ে আনা, টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তোলা, পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন ধরন নিশ্চিত, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জরুরি কর্মব্যবস্থা গ্রহণ, সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার, বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও জীববৈচিত্র্য হ্রাস প্রতিরোধ, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী বৈশ্বিক অংশীদারত্ব। লক্ষ্যগুলো থেকে এ কথা সহজেই বোধগম্য যে, এসডিজি কোন একটি দেশের জন্য নয়, এটি মানবসভ্যতার বৃহত্তর কল্যাণের জন্য।
এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশ কল্পনাতীত সফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে। এর বর্তমান সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৬৩.৫%। গত বছর যা ছিল ৬৩.২৬%। বর্তমানে এসডিজি সূচকে বিশ্বের ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। ২০১৭ সালে ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০তম ছিল আমাদের দেশ। এসডিজির ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়, দেশে দরিদ্র ও অতি দরিদ্র বা হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে যা এসডিজি-১ কে সমর্থন করে এবং এটি প্রতিবেদনের কমলা তালিকায় রাখা হয়েছে। এসডিজি-১ ছাড়াও এসডিজি-২, এসডিজি-৫, এসডিজি-৭, এসডিজি-৮ ও এসডিজি-১০ ও রয়েছে কমলা তালিকায়। অর্থাৎ এই লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশের সামনে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসডিজি-৩, এসডিজি-৬, এসডিজি-৯, এসডিজি-১১, এসডিজি-১৪, এসডিজি-১৫, এসডিজি-১৬ ও এসডিজি-১৭-কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে লাল তালিকায়। সুতরাং এই লক্ষ্যগুলো পূরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এসডিজি-৪-কে হলুদ তালিকায় রাখা হয়েছে, যার অর্থ এই লক্ষ্য অর্জনে আরো অনেক কাজ করতে হবে। সবুজ তালিকায় রয়েছে শুধুমাত্র এসডিজি-১২ ও এসডিজি-১৩। অর্থাৎ বাংলাদেশ এই দুই লক্ষ্য অর্জনে সফল কাম হয়েছে।
এসডিজি আমাদের দেশের জন্য উন্নয়নের একটি মাইলফলক। এদেশের মানুষ একসময় অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাতো, দরিদ্র ও নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। পাশাপাশি বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডোর মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকত। ২০১৫ সালে এসডিজি গ্রহণের প্রাক্কালে দেশে দরিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ২৪.৩% মানুষ এবং ২০১৭ সালেই তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩.১% এ। ২০১৫ সালে অতিদরিদ্র মানুষ ছিল ১২.৯%, ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১২.১% এ। খাদ্য উৎপাদনেও আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। বিশ্বে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ ৩য় স্থানে রয়েছে, ইলিশ মাছ উৎপাদনে হয়েছে দ্বিতীয়। অন্যান্য খাদ্য উৎপাদনেও আমরা স্বয়ংসম্পন্ন। এমনকি দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা হয় বাংলাদেশের খাদ্যশস্য ও অন্যান্য সামগ্রী।
বাংলাদেশ সরকার সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করেছে। বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে এবং মিড-ডে মিলের ব্যবস্থাও চালু রয়েছে। নারীদের বিশেষ ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা হচ্ছে। আজ পুরুষের থেকে নারীরাই ঋণ গ্রহণ ও প্রদানে এগিয়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা জোর দিচ্ছি প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর ওপর। যেমন সৌরশক্তি, পারমাণবিক শক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস ও বায়োগ্যাস, জৈবজ্বালানি ইত্যাদি। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ছিল মাত্র ৫২৭১ মেগাওয়াট এবং বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪,৪২১ মেগাওয়াটে। বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করতে পারছে দেশের ৯৯% মানুষ। শক্তি উৎপাদনের ফলে যেন পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয় সেদিকেও বিশেষ লক্ষ্য রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন জনসংখ্যাকে সমস্যা মনে করার পরিবর্তে জনশক্তিতে রূপান্তর করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট ৭৫.৪। বেকারত্বের গ্লানি যেন কোন জীবন কেড়ে নিতে না পারে তার জন্য উদ্যোক্তা তৈরি করা হচ্ছে এবং অন্যান্যদেরও উৎসাহিত করা হচ্ছে। স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। এমন অনেক তরুণ-তরুণী আছে যারা উদ্যোক্তা হয়ে তাদের পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করছে। বেকারত্ব আর তাদের পীড়া দিতে পারে না।
এসডিজির সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে আমাদের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: সম্পদের সংহতকরণ ও মানোন্নয়ন। আমাদের পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, সেগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহারের সম্ভাবনা পুরোপুরি ফলপ্রসূ করতে হবে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। দেশের প্রতিটি কোণায় কোণায় বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে যাতে করে আমরা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও সক্ষমতা অর্জন করতে পারি। অবৈধ অর্থ প্রবাহ বন্ধ করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশ হলে কম সুদে ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে। সেগুলো মোকাবেলা করতে হতে হবে এবং উত্তরণের পথ বের করতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। টেকসই উন্নয়নে সুশীল সমাজের অবদানের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং নিকট ভবিষ্যতে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার মত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। টেকসই উন্নয়নে একাধারে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উৎকর্ষ সাধিত হয় যা একটি সমাজ তথাপি একটি দেশের আমূল পরিবর্তন করতে সক্ষম।
বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার রোডম্যাপ রয়েছে। এছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট অর্জন এবং ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা মোতাবেক আমরা সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। এজন্য সকলকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। টেকসই উৎপাদন ও ভোগের জন্য সরকার, উৎপাদনকারী, উদ্যোক্তা, গণমাধ্যমসহ সকল নাগরিককে এক প্ল্যাটফর্মের নিচে এসে কাজ করতে হবে। এমডিজিতে ৮টি লক্ষ্য পূরণের জন্য আমরা ৮টি পুরস্কার পেয়েছিলাম। এসডিজিতেও প্রতিটি লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে। তবেই আমরা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন