গত শনিবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে হাসপাতালের এক ওয়ার্ডবয়ের মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্সের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে ৫ জন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অ্যাম্বুলেন্সের চালকের আসনে ছিল চালকের সহকারী। সে দ্রুতগতিতে অ্যাম্বুলেন্সটি চালিয়ে হাসপাতাল চত্বরে মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে এতে পাঁচজন চাপা পড়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় দায়িত্বে থাকা পুলিশের বিশেষ শাখার এক উপ-পরিদর্শক জানিয়েছেন, অ্যাম্বুলেন্সটিতে কোন রোগী ছিল না। কোন রকম হর্ণ না বাজিয়ে সেটি দ্রুত হাসপাতাল চত্বরে প্রবেশ করে। নিহত সাকিবের বাবা আহত ফেরদৌস জানিয়েছেন, দুইদিন আগে সাকিব এলাকায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আহত হবার পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শুক্রবার ঢাকায় আনা হয়। সকালে রিকশায় স্ত্রী, দুই ছেলেসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন তারা। রিকশা থেকে নেমে হাসপাতালে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স পেছন থেকে তাদের চাপা দেয়। গত ২২ তারিখ থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আমেনা বেগমের স্বামী জানিয়েছেন, তার স্ত্রী ও আট বছরে সন্তান সকালে হাসপাতালের বাইরে নাস্তা কিনতে গিয়ে ফেরার পথে অ্যাম্বুলেন্সের নিচে চাপা পড়েছে। যে অ্যাম্বুলেন্স মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেই অ্যাম্বুলেন্সের চাপায় মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাকে অবিশ্বাস্য ও দুঃখজনক ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে এধরনের ঘটনা বিরল হলেও এই হাসপাতাল বা হাসপাতালকে ঘিরে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস প্রদানকারীদের দৌরাত্ম্য নতুন কিছু নয়। অসুস্থ রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া বা লাশ পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবহার জরুরি। দুঃখের বিষয়, মানবতা ও সেবার প্রতীক বলে বিবেচিত অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলছে অমানবিক বাণিজ্য। সরকারী হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের। প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, এখানে অন্তত ৮০টি বেসরকারী অ্যাম্বুলেন্স দিনের পর দিন সেবার নামে রোগীদের জিম্মি করে রমরমা ব্যবসা করছে। ঢামেককে ঘিরে অধিকাংশ বেসরকারী অ্যাম্বুলেন্সের মালিকই ওই হাসপাতালের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। একই দৃশ্য মিটফোর্ড ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেরও। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এর সাথে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সম্পর্ক রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হাসপাতালের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী অ্যাম্বুলেন্স কেনার মতো এত অর্থ পায় কোথা থেকে? বলা বাহুল্য, অ্যাম্বুলেন্সকে ঘিরে আরো বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগও রয়েছে, সীমান্ত অঞ্চলে সরকারী অ্যাম্বুলেন্সে মাদক বহন করা হয়। আবার যখন বিরোধী দলের কোন কর্মসূচী হয় তখন অ্যাম্বুলেন্সে করে সরকারী কর্মকর্তাদের যাতায়াতের খবরও ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ যে নির্দিষ্ট সেবার জন্য যা ব্যবহৃত হবার কথা তার পরিবর্তে এর অপব্যবহার করা হচ্ছে। এমন খবরও বেরিয়েছে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার আড়ালে কর ফাঁকির ঘটনাও ঘটছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স সেবার নামে যে জমজমাট ব্যবসা চলছে তা রোগীদের এক প্রকার জিম্মি করেই করা হচ্ছে। একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা করে যাচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এব্যাপারে অনেকটা নির্বিকার রয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্স কোন ব্যবসায়ী খাত হতে পারে না। মানুষের অসহয়াত্বকে পুঁজি করে ব্যবসা করা উচিত নয়। এধরনের ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তাদের মধ্যে মনুষত্ব বলতে কিছুই নেই। এই রাজধানীতেই বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা প্রকৃত অর্থেই মানবতার সেবা করছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে রোগীদের জিম্মি করে যে ব্যবসা চলছে তা কোনোভাবেই চলতে দেয়া যায় না। আলোচ্য দুর্ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে। এসব অসাধু অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ী কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই ব্যবসা বা সিন্ডিকেটের সাথে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। আলোচ্য দুর্ঘটনায় যারা নিহত ও আহত হয়েছে তাদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা উপেক্ষণীয় নয়। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি আমলে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন