মানুষের মধ্যে এমন কিছু বদস্বভাব রয়েছে যা নিকৃষ্ট ও সবার কাছেই অপছন্দনীয়; এ জাতীয় স্বভাব-চরিত্রকে ‘আখলাকে সায়্যিআ’ বলা হয়। আখলাকে সায়্যিআ’র অন্যতম হলো- অহংকার বা আত্মম্ভরিতা। ইসলামের দৃষ্টিতে অহংকার করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং বান্দার যে সব কাজে কবিরা গুনাহ্ হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো অহংকার; যা মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া ত্বরাণি¦ত করে। অহংকারের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছিল দুনিয়ায় প্রথম পাপ। অহংকারি মানুষকে আল্লাহ্ খুব অপছন্দ করেন। তিনি সূরা নাহল-এর ২৩ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অহংকারিদের ভালোবাসেন না।’ এছাড়াও তিনি সূরা আ‘রাফের ১৪৬ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার নিদর্শনাবলি থেকে বিমুখ করে রাখব।’
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। নবি (স.) বলেছেন, ‘অহংকার হচ্ছে- সত্যকে উপেক্ষা করা এবং মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।’ (মুসলিম: ৯১) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, ‘তোমরা যা ইচ্ছা খাও এবং যা ইচ্ছা পরিধান করো এ শর্তে যে অহংকার ও অপব্যয় করবে না। (বুখারি)। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, যারা পৃথিবীতে দম্ভসহকারে পদচারণা করেছে তাদের পরিণতি হয়েছিল অত্যন্ত বিষাদময় ও নির্মম। আমরা ফেরাউন, নমরুদ, আবু জাহেল এবং আদ-সামুদ জাতির মর্মন্তুদ পরিণতির কথা কম বেশি সবাই জানি। সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক আত্ম-গর্বিত ব্যক্তিকে কখনো পছন্দ করেন না।’ এ প্রসঙ্গে হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: সম্মান হচ্ছে- আল্লাহর পরনের কাপড়; আর অহংকার হচ্ছে- আল্লাহর চাদর। যে ব্যক্তি এটা নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করে আমি তাকে শাস্তি দেই। (সহিহ্ মুসলিম: ২৬২০) আত্মার ব্যাধিসমূহের মধ্যে অহংকার ও আত্মম্ভরিতা হচ্ছে গুরুতর একটি ব্যাধি। অহংকার মানে হচ্ছে নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় জ্ঞান করা এবং অন্যকে তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট মনে করা। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেছে শয়তান। এর শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ্ তা’আলা শয়তানকে বেহেশত থেকে বহিষ্কার করেছেন এবং অধমদের দলে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। এ মর্মে সূরা আ‘রাফের ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, ‘তুমি এই স্থান হতে নেমে যাও, এখানে থেকে অহংকার করবে তা হতে পারে না। সুতরাং বের হয়ে যাও। তুমি অধমের অন্তর্ভূক্ত।’ হযরত হারিসাহ্ ইবনে ওহাব খুযায়ী (রা.) হতে বর্ণিত। নবি (স.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের জান্নাতীদের সম্পর্কে জ্ঞাত করবো না? (তারা হলেন) ঐ সকল লোক যারা অসহায় এবং যাদের তুচ্ছ মনে করা হয়। তারা যদি আল্লাহ্র নামে শপথ করে, তাহলে তা তিনি নিশ্চয়ই পুরা করে দেন। আমি কি তোমাদের জাহান্নামীদের সম্পর্কে জ্ঞাত করবো না? তারা হলো- কর্কশ স্বভাবের, শক্ত হৃদয়ের অধিকারি ও অহংকারি। (সহিহ্ মুসলিম: ১৬৯) অহংকারের কুফল বর্ণনাতীত। অহংকারী ব্যক্তি যেহেতু নিজেকে অন্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে এ কারণে সে সাধারণ মানুষের সাথে উঠা-বসা, পানাহার ও কথাবার্তা বলাকে নিজের মর্যাদার খেলাপ মনে করে। যখন সে মানুষের সাথে মিলিত হয় তখন কামনা করে যে, মানুষ তাকে সম্মান করুক। ঐ কারণে আল্লাহ তা‘আলা দাম্ভিক ও অহংকারি ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। এ মর্মে সূরা লুকমানের ১৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন, ‘অহংকারের বশবর্তী হয়ে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কোনো দাম্ভিক অহংকারিকে পছন্দ করেন না।’ এছাড়াও সূরা বনি ইসরাঈলের ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ্ পাক বলেন, ‘পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূ-পৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।’ এ মর্মে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহংকারবশত: কাপড় ঝুলিয়ে হাঁটবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার দিকে তাকাবেন না।’(সহিহ্ বুখারি: ৩৪৬৫) হযরত হারেছা ইবনে ওহাব (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি (স.) বলেছেন, ‘অহংকারী ও অহংকারের মিথ্যা ভানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (সুনানে আবু দাউদ)
অহংকারি ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) ইরশাদ করেন, ‘যার অন্তরে কণা (অণু) পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহিহ মুসলিম: ১৬৯, মিশকাত শরিফ, পৃ. ৪৩৩)
এছাড়াও হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (স.) ইরশাদ করেন, ‘জাহান্নাম ও জান্নাত পরস্পর তর্ক করছিল। জাহান্নাম বললো, আমাকে দাম্ভিক ও অহংকারি মানুষ দেওয়া হয়েছে, যা তোমাকে দেওয়া হয়নি। জান্নাত বললো, আমার কী দোষ যে দুর্বল, অক্ষম ও গুরুত্বহীন মানুষগুলোই আমার ভেতর প্রবেশ করছে।’ (সহিহ্ মুসলিম: ২৮৪৬)
পরিশেষে বলা যায় যে, পার্থিব জগতে প্রত্যেকটি মানুষই পরস্পরের মুখাপেক্ষী। কোনই মানুষই অভাবমুক্ত নয়। তাই মানবকুলের অহংকার শোভা পায় না। একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলাই মুতাকাব্বির (অহংকারী)। কারণ অহংকার হলো তাঁর চাদর। সকল প্রকার বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী তিনি। তাই অহংকার করা কেবলমাত্র তাঁকেই শোভা পায় মানুষকে নয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন