এক পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রতি বছর ব্রেইনের রোগ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। সংখ্যাটা চমকে ওঠার মতো। এই আক্রান্তদের তালিকায় আমাদের পরিবারের সদস্য থেকে নিকটাত্মীয় যে কেউ থাকতে পারেন। মস্তিকে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক নিছক ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা নয়, এটা একই সঙ্গে সামাজিক ও পারিবারিক একটি সংকট ও বিপর্যয় বটে। একজন কর্মক্ষম মানুষ হারাচ্ছেন তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা এবং চিকিৎসার জন্য ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। যা একটি সাধারণ পরিবারকে সংকটে ফেলে দেয়।
স্ট্রোক বিশ্বজনীন একটি সমস্যা। এ রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে “ওয়ার্লড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন” ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর পালন করে আসছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। আমাদের দেশেও মানুষকে সচেতন করতে এটা পালিত হয়। ২০২১ সালের বিশ্ব স্ট্রোক দিবসের থিম “মাইনুটস্ কেন সেভ লাইফ”- “স্ট্রোকের লক্ষণ গুলোকে জানুন এবং মূল্যবান সময় বাচানগ্ধ ।
স্ট্রোক কি?:
স্ট্রোককে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় সেরিব্রভাসকুলার এক্সিডেন্ট বলা হয়। আমাদের দেশে ধারণা প্রচলিত আছে যে স্ট্রোক হার্ট বা হৃৎপিন্ডের রোগ অর্থাৎ হার্ট এটাকের মত একটা কিছু। কিন্তু বাস্তবে এটা তা নয়। স্ট্রোক সম্পূর্ণ মস্তিকের একটি দুর্ঘটনা বা ব্রেনের রক্তনালীর জটিলতাজনিত মারাত্মক একটি সমস্যা। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কোনো কারণে বিঘ্নিত হলে স্ট্রোক সংঘটিত হয়। বিশেষ করে রক্তনালী বন্ধ হয়ে কিংবা রক্তনালী ছিঁড়ে মস্তিষ্কে এই রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। রক্তে থাকে অক্সিজেন আর পুষ্টিগুণ। ফলে অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের টিস্যুগুলো মারা যেতে থাকে।
স্ট্রোক কাদের হয়?:
৬০ বছরের বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ স্ট্রোক। যদিও বৃদ্ধ বয়সে স্ট্রোক বেশি হয়, কিন্তু বর্তমানে অল্প বয়সে স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার ঘটনাও ঘটছে। নারীর চেয়ে পুরুষদের মধ্যেই স্ট্রোকের প্রবণতা সচরাচর বেশি দেখা যায়। যদিও এর নানা কারণ আছে।
স্ট্রোক প্রধানত দুই প্রকার :
(১) ইস্কেমিক স্ট্রোক : এই ধরনের স্ট্রোকে ব্রেনে আঞ্চলিকভাবে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মস্তিকের আক্রান্ত এলাকাটি রক্ত পায় না এবং টিস্যু মারা যায়।
(২) হেমোরেজিক স্ট্রোক : এখানে রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে এবং মস্তিস্কের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এতে মস্তিস্ক তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুহার ৫০%।
স্ট্রোক কেন হয় ?:
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ। এছাড়া অতিরিক্ত টেনশন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস, রক্তে বেশি মাত্রায় চর্বি বা কোলেস্টেরল, ধুমপান, অতিরিক্ত ওজন, এলকোহল সেবন স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়ায় বা দায়ী। এছাড়া অনিয়মিতভাবে ব্লাড প্রেসারের ঔষধ সেবনের ফলে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ স্ট্রোক ঘটায়। উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে নিয়মিত হেলথ চেক-আপ জরুরি। কিন্তু আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষজন উদাসীন ; হেলথ চেক-আপকে বিলাসিতা মনে করে। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, হেলথ চেক আপ করালে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ লোক স্ট্রোক এড়াতে পারেন।
স্ট্রোক এর লক্ষণ সমূহ :
১. মাথা ঘুরানোর সাথে সাথে চোখে ঝাপসা দেখা, চারদিক অন্ধকার লাগা বা ডাবল দেখা।
২. হাঁটতে অসুবিধা এবং ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা হওয়া, মস্তিষ্কের কোষগুলো শরীরের যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করে ওই অংশও প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে।
৩. সমস্ত শরীর ঘেমে যেতে পারে।
৪. দুর্বলতা বা অবশ লাগা, শরীরের একপাশ অকেজো হয়ে যাওয়া, অনেক সময় হাত-পা অবশ হয়ে যায়।
৫. মুখ বেকে যাওয়া।
৬. কথায় জড়তা বা কথা বলতে সমস্যা হওয়া।
৭. হঠাৎ অসহ্য মাথা ব্যথার সাথে বমি হওয়া এবং প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা।
স্ট্রাক প্রতি!রাধ!যাগ্য রাগ :
স্বাস্থ্যসম্মত জীবন ব্যবস্থা বজায় রাখলে অনেকখানি ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
➢ স্ট্রোক থেকে রক্ষা পেতে হলে নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা উচিত। উচিত কমপক্ষে রোজ ৪৫ মিনিট ঘাম ঝরিয়ে হাঁটা।
➢ নিয়মিত সঠিকভাবে ঔষধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
➢ চর্বি ও অতিরিক্ত শর্করাাযুক্ত খাবার যেমনঃ ফাস্টফুড, ঘি, মাখন, চর্বি, বিরিয়ানী, চিংড়ি, গরু-খাসির মাংস, ডিমের কুসম যতটুকু সম্ভব পরিহার করুন। ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য এসব খাবার গ্রহণ একদম উচিত নয়।
➢ ধুমপান এবং মাদক সেবনকে না বলুন।
➢ যে কোন প্রতিকূল পরিবেশেও স্বাভাবিক থাকুন, সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করুন, দৈনিক ৬ ঘন্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম নিশ্চিত করুন।
আক্রান্ত হলে করণীয়:
স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলেই রোগীর অবস্থা বা প্রকৃতি অনুযায়ী অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে অথবা একজন নিউরো মেডিসিন বা স্নায়ু রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে স্ট্রোকের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত অর্থাৎ মাল্টিডিসিপ্লিনারী পরিকল্পনার চিকিৎসা ব্যবস্থা। যেমন কোনো কোনো স্ট্রোক রোগীর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে অপারেশন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে নিউরো সার্জনের সহযোগিতা কাম্য। পাশাপাশি অনেক স্ট্রোক রোগীর হার্টের রোগ থাকে। এসব ক্ষেত্রে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শের প্রয়োজন পড়ে।
এছাড়া পুর্নবাসনের জন্য ফিজিওথেরাপিষ্ট নানাবিধ ব্যায়ামের মাধ্যমে অঙ্গ সঞ্চালন করে রোগীর জড়তা কাটিয়ে তোলেন। একজন স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর মনোযাতনা প্রবল হয়ে থাকে। তিনি পরিস্থিতির আকস্মিকতায় বিপন্নবোধ করেন, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। যা তার শারীরিক উন্নতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই স্ট্রোকের রোগীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিবারের লোকজনের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা, নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং যত্ন। পিঠের ঘা থেকে রক্ষার জন্য খেয়াল রাখতে হবে, নিয়ম মেনে পাশ ফিরিয়ে রাখতে হবে। রোগীকে মানসিকভাবে সাহস যোগাতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় ফিজিওথেরাপী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কাজেই স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর জন্য আমাদের সকলের উচিত স্বাস্থ্যকর জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং দেরি না করে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
ডাঃ মোঃ আব্দুল হাফিজ শাফী
সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন