শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শেয়ারবাজারে আতঙ্ক দূর করতে হবে

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

করোনা মহামারির আঘাত সামলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। মহামারির এই কালপর্বে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রয়েছে। প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার এক অসীম সাহস ও ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য শক্তি আমাদের নতুন নয়। বাংলাদেশে করোনার আগেরকার আর্থ-সামাজিক উন্নতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয়। তবে এখনকার অর্থনীতির অগ্রগতিও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও দাতাসংস্থার পর্যবেক্ষণে প্রতিনিয়ত উঠে আসছে। বলা হয়ে থাকে, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার নির্ভর করবে টিকাদান কর্মসূচির ওপর। অথচ, স্বল্পসংখ্যক মানুষকে টিকা দিয়ে আজ করোনা নিয়ন্ত্রণেই বলা চলে। কয়েক সপ্তাহ ধরে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দুই শতাংশের নিচে রয়েছে। কমেছে মৃত্যুও। করোনা সংক্রমণ কমে আসায় আপাতত জনমনে প্রশমিত হয়েছে করোনা আতঙ্ক। তবে গত ১০ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায় আর এক আতঙ্কের নাম। এটি শেয়ারবাজার পতনের আতঙ্ক, যার জোরে শেয়ারবাজারে চলছে অস্থিরতা। শেয়ারবাজার ও আতঙ্ক একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে, যা বিনিয়োগকারীদের মনোজগতে শক্তপোক্তভাবে গ্রথিত। কিন্তু এটি এমন হওয়ার কথা নয়। তবে কী হতে পারত? এর উত্তর সহজেই অনুমেয়।

এটা তো সবারই জানা, শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থাৎ যদি বিনিয়োগের আগে ঝুঁকি শব্দটা মাথায় থাকত, তবে আজকে তা আতঙ্কে পরিণত হতো না। এখানে ঝুঁকি আছে মেনেই বিনিয়োগ করতে হবে। শুধু লাভের আশায় বিনিয়োগ করলে হবে না। যে কোনো দেশে শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান বিকাশের অনুকূল দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসেবে শেয়ারবাজারের মতো একটি গুরত্বপূর্ণ মাধ্যম থেকে বিপুল পরিমাণে পুঁজি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে ঠিক এর উল্টো। এখানে শেয়ারবাজারের বদলে ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে আর্থিক খাতের এই প্রতিষ্ঠানটি বিগত ৬৭ বছরেও শক্ত কোনো ভিতের ওপর দাঁড়ায়নি, এখানে প্রতিনিয়ত চলছে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, সর্বগ্রাসী অরাজকতা, আস্থাহীনতা, আইনের শাসন অনুপস্থিতি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের নিষ্ক্রিয়তা, অকার্যকারিতা, লুটপাট ও কারসাজির এক মহোৎসব। এক অস্থিতিশীল পরিবশেই ঘুরপাক খাচ্ছে শেয়ারবাজার। এক কার্যদিবস কিছুটা উত্থান হলে এর পরের কার্যদিবসই পতন হচ্ছে। আর এই উত্থান ও পতনের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেশি। এটি মোটেও সুষ্ঠু পরিপক্ক বাজারের লক্ষণ নয়। কেনো এরকম হয়? উত্তর খুঁজলে পাওয়া যায়, শেয়ারবাজার যখন টানা ঊর্ধ্বমুখী থাকে, তখন সাধারণ বিনিয়োগকারী ভুলে যান সূচকের কারেকশন বা শেয়ারদরের মূল্য সংশোধন অবধারিত। আর শেয়ারদরের যখন মূল্য সংশোধন চলতে থাকে, তখন এর পালে হাওয়া দেয় অসাধু চক্র। ফলে কারেকশন পতনে রূপ নেয়। টানা পতন চলতে থাকায় আতঙ্ক ভর করে বিনিয়োগকারীদের মনে। কোনো প্রকার বাছবিচার ছাড়াই শেয়ার বিক্রি করে এ পতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আর উত্থান-পতনের এই পরিক্রমায় আবার কম দামে শেয়ার কিনে নেয় স্বার্থ শিকারী চক্র। এই চক্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কারসাজির ফাঁদে ফেলে, বিভিন্ন গুজবের মারপ্যাঁচে প্রলুব্ধ করে সর্বশান্ত করে খুব সহজেই হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। নিঃস্ব হন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে বাজারে চাঙ্গাভাব ফিরতে শুরু করে। আর মে মাসে ঈদের আগে-পরে বাজার আরও গতি পায়। লেনদেনেও দেখা যায় চাঙাভাব। এতে প্রতিদিনই বাজারে নতুন নতুন বিনিয়োগ বা অর্থ লগ্নি হয়। বিশেষ করে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে আবেদনের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপের কারণেও বিপুল বিনিয়োগ আসে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীই আগ্রসী ছিলেন। ফলে শেয়ারবাজারে প্রধান সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধনে হয় নতুন নতুন রেকর্ড। রেকর্ডের এই ধারাবাহিকতায় সূচক পৌঁছায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার পয়েন্টে। গত এক বছরে সূচক বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পয়েন্ট। ছয় হাজার পয়েন্টের পরে বলা চলে সূচক প্রায় টানা বেড়েছে। ফলে স্বল্পমূলধনী অনেক কোম্পানির শেয়ারেরদর অতিমূল্যায়িত হয়েছে। আবার কিছু শেয়ারেরদর কারসাজির মাধ্যমে অল্প সময়ে এতটাই বাড়ানো হয়েছে যে, তা কোনোভাবেই ওই কোম্পানির আর্থিক ভিত্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এর মধ্যে কোনো মূল্য সংশোধন হয়নি। সেখান থেকে কিছু মূল্য সংশোধন হওয়া স্বাভাবিক। তবে গত ১০ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলা দরপতন বিনিয়োগকারীদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে গত ২৪ ও ২৫ অক্টোবর-এই দুই দিনে সূচক কমে ১৯১ পয়েন্ট। ফলে সূচক নেমে আসে বহু কাঙ্খিত ৭ হাজার পয়েন্ট মাইলফলকের নিচে এবং বেশকিছু শেয়ারের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মূল্য সংশোধন হয়। এর পেছনেই কারসাজির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। এটা অস্বীকারের উপায় নেই, আমাদের শেয়ারবাজার অনেকটাই গুজবনির্ভর। পৃথিবীর সব শেয়ারবাজারেই গুজব রয়েছে। একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারী নিজের বিশ্লেষণী জ্ঞান দিয়ে গুজবকে প্রতিহত করেন। গুজব থেকে সাবধান থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, কারসাজি চক্র নিজেদের স্বার্থ হাসিলে বাজারে গুজব ছড়ায়। একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারী কখনো গুজবে কান দেন না। প্রকৃত বিনিয়োগ কখনো গুজবে হওয়া উচিত নয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ারবাজার নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়ায়। তবে আশার কথা হলো, এসব ব্যক্তি ও গ্রুপকে আইনের আওতায় আনতে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত ২৪ মে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির কাজ হবে শেয়ারবাজারে গুজব প্রচারকারীদের খুঁজে বের করে সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনা।

এ ক্ষেত্রে মূলত বিনিয়োগকারীদেরই সচেতন থাকতে হবে। বিনিয়োগকৃত কোম্পানি সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ খবর নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে তথা গুজব ও প্রকৃত তথ্যের সত্যতা বিশ্লেষণের ন্যূনতম জ্ঞান থাকতে হবে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা হরহামেশাই তথাকথিত আইটেম খোঁজার নামে গুজবের জালে আচ্ছন্ন থাকেন। তারা বিনিয়োগে গুজবেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিনিয়োগকারীরা হাউসে বসে খোশগল্পে মেতে উঠেন এবং কোনো প্রকার বাছবিচার ছাড়াই প্রায়শ ভুল বিনিয়োগ করেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নেন না। আবার গুজবের পিছনে ছোটেন। বিনিয়োগকারীরা অতীত মনে রাখেন না। বর্তমান নিয়ে সর্বদা হতাশায় ভোগেন। আর ভবিষ্যৎ তথা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে তারা অভ্যস্ত নন। এ ক্ষেত্রে ব্রোকার হাউসকেও সুষ্ঠু টেকসই বাজারের লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে। ট্রেডারদের আরও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। যারা প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীদের নৈতিকভাবে ভালো বিনিয়োগ পরামর্শ, উৎসাহ ও সচেতন করবে। আমাদের শেয়ারবাজার বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো, এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি থেকে শুরু করে বাজারসংশ্লিষ্টদের দক্ষতা ও জ্ঞানের অভাব। শেয়ারবাজারে প্রথম ও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, একটি প্রশিক্ষিত বিনিয়োগ শ্রেণি গড়ে তোলা। কেননা একটি সুষ্ঠু, টেকসই ও দক্ষ শেয়ারবাজারের জন্য প্রয়োজন দক্ষ বিনিয়োগকারী, যারা নিজেদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেবেন এবং কখনোই গুজবে কান দেবেন না। বিনিয়োগকারীরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন, একটি দেশের শেয়ারবাজার টেকসই বা স্থায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর দক্ষতার ওপর? মানুষের ভয় আসে অজ্ঞনতা থেকে। এই ভয় যখন সার্বিকভাবে জেঁকে বসে, তখন তা আতঙ্কে পরিণত হয়। বাঁচার উপায় জানতে হবে। একমাত্র জানাশোনার মাধ্যমেই অজ্ঞনতা দূর করে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে, যা বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক দূর করবে। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নতুন ট্রেকের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগশিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।

লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন