শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিপ্লবী কবি আল্লামা ইকবাল

ড. আবুল কালাম | প্রকাশের সময় : ১১ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

আল্লামা ইকবাল ছিলেন বিশ শতকের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও ইসলামী চিন্তা ধারার সার্থক ভাষ্যকার। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, চিন্তানায়ক ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে সুপণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। ইকবালের প্রাথমিক শিক্ষার পর্ব সমাপ্ত হয় শিয়ালকোটের সুবিখ্যাত পন্ডিত শামসুল উলামা মীর হাসানের তত্ত্বাবধানে। মীর হাসান ইকবালের কাব্য প্রতিভার আভাস পেয়ে তাঁকে উৎসাহিত করেন। শুরু হয় ইকবালের কাব্যচর্চা। ইউরোপে তিনি পরিচিত ছিলেন, Poet of The East হিসেবে।

ইকবাল প্রধানত উর্দু ও ফার্সি ভাষায় কাব্যচর্চা করে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর উর্দু কাব্যগ্রন্থগুলি হলো: শেকওয়া, জওয়াবে শেকওয়া, বাংগে দারা, বালে জিব্রীল, জরবে কলীম। আর ফার্সি ভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ হলো ৭টি: ‘পয়ামে মাশরিক’, ‘আসরারে খুদী,’ ‘রমুযে বে-খুদী’, ‘যবুরে আযম’, ‘জাভীদনামাহ’, ‘পসচে বায়দ করদ আয় আকওয়ামে শরক্ক’ ও ‘মুসাফির’। ‘আরমগানে হেযায’ উর্দু ও ফার্সি ভাষায় মিশ্রিত গ্রন্থ।

তাঁর বিখ্যাত ‘তারানা’ ‘চীন ও আরব হামারা, হিন্দুসতা হামারা, মুসলিম হ্যায় হাম ওয়াতান হ্যায় সারা জাহা হামারা’ (‘চীন আমার, আরব আমার, ভারতও আমার নয়কো পর, জগত জোড়া মুসলিম আমি, সারাটি জাহান বেঁধেছি ঘর’) সারা উপমহাদেশে খুবই জনপ্রিয়। তাঁর ফার্সি ও উর্দু কবিতা আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইকবাল তাঁর ধর্মীয় ও ইসলামী রাজনৈতিক দর্শনের জন্যও বিশেষভাবে সমাদৃত।

প্রত্যেক যুগের প্রতাপশালী জাতিগুলো বিশ্বের উপর আধিপত্য কায়েম করেছে। এখন যেমন পাশ্চাত্যের আধিপত্য। মিসরের ফিরাউন বংশ, আরবের আদ ও সামুদ, ইরাকের কালদানি, ইরানের কিসরা, গ্রিসের দিগ্বিজয়ী বীর, রোমের বিশ্ববিশ্রুত সম্রাট, জগজ্জয়ী মুসলিম মুজাহিদ, তাতারীদের দুনিয়াখ্যাত সেনাবাহিনী প্রমুখ সবাই এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে একই রূপ প্রতাপ ও শক্তির প্রকাশ দেখিয়ে গেছেন। পালাক্রমে এরা প্রত্যেকেই আপন নৈপুণ্য দেখিয়ে একইভাবে দুনিয়ার মানুষকে বিস্মিত করে দিয়েছেন। যখন যে জাতিই মাথা তুলেছে, এভাবেই সে দুনিয়ার ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। এমনি করেই সে বিশ্বময় নিজের খ্যাতি, যশ ও বীর্যবত্তার ডঙ্কা বাজিয়েছে আর এভাবেই দুনিয়ার মানুষ ধারণা করে নিয়েছে যে, তাদের শক্তি ও ক্ষমতা অক্ষয়, অবিনশ্বর। কিন্তু তাদের আয়ুষ্কাল যখন পূর্ণ হয়ে গিয়েছে এবং অক্ষয় ও অবিনশ্বর ক্ষমতার অধিকারী সম্রাট তাদের কর্তৃত্বের অবসান ঘোষণা করেছেন, তখন তাদের এমনি পতন ঘটেছে যে, অধিকাংশ জাতিই দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

রাষ্ট্রনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য জাতিগুলো বিস্ময়কর উন্নতি করেছে। তা দেখে একশ্রেণির মানুষ মনে করে যে, ঐ জাতিগুলোর উন্নতি ও তরক্কী হয়তো বা অক্ষয়। তাই বহু জাতি তাদের প্রভুত্ব স্বীকার করেছে। কিন্তু আল্লামা ইকবাল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Reconstruction of Religious Thought in Islam-এর মধ্যে আলোচনা করেছেন যে, যেহেতু আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে, সেই জন্য কোনো জাতির দাসত্ব স্বীকার না করে আল্লাহ্র প্রভুত্ব ও দাসত্ব স্বীকার করা অনিবার্য কর্তব্য। তাঁর দেওয়া বিধানই চিরস্থায়ী এ বিধান তা মনে প্রাণে মেনে নেওয়া উচিৎ। আল্লামা ইকবাল আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন পশ্চিমা চিন্তায় আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অভাব কত ব্যাপক।

ইকবাল আধুনিক চিন্তাবিদদের মধ্যে যুগান্তকারী হিসেবে পরিগণিত। মুসলিম জাতির অধঃপতন তাকে পীড়া দিয়েছিল। এক সময়ের বিশ্ববিজয়ী মুসলিম জাতির অধোগতির কারণ খুঁজতে থাকেন নিয়ত। কবিতা ও দর্শনের মাধ্যমে সেই অধোগতির কারণ বিশ্লেষণ ও সমাধানের নির্দেশনা দান করেন। জাতিকে আত্মকলহ, ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বিভেদ ভুলে সাম্য, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের পতাকাতলে সমবেত হবার আহবান জানান। ইকবাল নতুন সমাজ চেয়েছেন; ইসলামের শিক্ষাকে দেখেছেন বৈপ্লবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। দেখিয়েছেন পশ্চিমা অভিজ্ঞতাবাদের সাথে ইসলামের বিরোধ নেই। বরং ইসলাম দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে। কোরআন ইহজগৎ আর পরজগতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মানবজীবনের সর্বোচ্চ মূল্যবোধসমূহের বাস্তব রূপায়ণের নির্দেশনা দেয়। ইকবালের সেই চিন্তাধারা শুধু মুসলিম জাতিকেই উদ্বুদ্ধ করেনি; বিশ্বের প্রগতিশীল মানবমনকেও আন্দোলিত করেছে। আধুনিক মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার যে উৎসাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার যুগস্রষ্টা আল্লামা ইকবাল। আল্লামা ইকবালের লেখা পরবর্তী প্রজন্মের হৃদয়ে দিয়েছে বিপ্লবের শক্তি। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় দিয়েছে নতুন মাত্রা। আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক থেকে শুরু করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ইসলাম চিন্তকদের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টার পেছনে তার বাক্য অনুপ্রেরণার মতো।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি বিভাগ, শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন