আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়েছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা কোনো আলোচনা ছাড়াই সারাদেশে গণপরিবহন পরিচালনা বন্ধ করে দেয়। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাহী ট্রাক-লরি চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। পরিবহন সঙ্কটের কারণে যেমন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস-আদালত এবং মিল-কারখানাগামী চাকরিজীবী এবং খেটে খাওয়া মানুষকে পায়ে হেঁটে কিংবা তিন-চার গুণ অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান এমনকি ট্রাকে করে যাতায়াত করতে হয়। পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ থাকায় শাক-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পরিবহনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। সরবরাহ ঘাটতির কারণে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর মানুষকে যেমন অতিরিক্ত মূল্যে শাক-সবজি কিনতে হয়, তেমনি সারাদেশের মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। পরিবহন সঙ্কটের কারণে কৃষকের ফলানো শাক-সবজি ও অন্যান্য ফসল জমি বা স্থানীয় বাজারেই অবিক্রিত থেকে নষ্ট হয়। এত কিছুর পর সরকারের সাথে বৈঠক করে পরিবহন মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে নেয়। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। বরং ডিজেলের দাম বাড়ানোর অজুহাতে ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূলত পরিবহনমালিকদের ইচ্ছাই গুরুত্ব পায়। তারপরও দেখা যাচ্ছে, পরিবহন মালিকদের ইচ্ছানুসারে সরকার যে বর্ধিত ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটিও তারা মেনে চলছে না। যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে নানা অযুহাতে। গত মঙ্গলবার থেকে ভাড়ার পূর্ণাঙ্গ তালিকা সব গণপরিবহনে টানানোর কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। সিএনজির মূল্য বৃদ্ধি করা না হলেও সিএনজিচালিত পরিবহনগুলো বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। রাজধানীসহ মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোতে সিটিং সার্ভিস, গেইট লক, ওয়ে বিল ইত্যাদি নামে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে। গণপরিবহনের সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলেও আদায় করা হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। এই অবস্থা যে শুধু নগর পরিবহনগুলোর ক্ষেত্রে হচ্ছে, তা নয়। দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রেও যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে পরিবহনগুলো।
ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির পর দূরপাল্লার গাড়িগুলোতে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১ টাকা ৮০ পয়সা। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলার দূরত্ব এবং পরিবহনগুলোর বর্ধিত ভাড়ার হিসাব মিলিয়ে দেখা যায়, সেখানে যাত্রীদের পকেট থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৩৯৫ কিমি, ১ টাকা ৮০ পয়সা প্রতি কিমি হিসাবে ভাড়া হওয়ার কথা ৭১১ টাকা। কিন্তু নন-এসি সাধারণ গাড়িগুলোতে নেওয়া হচ্ছে ৯৫০ টাকা। অতিরিক্ত নিচ্ছে ২৩৯ টাকা। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দূরত্ব ২৭২ কিমি, ভাড়া হওয়ার কথা ৪৮৯ টাকা ৬০ পয়সা। নেওয়া হচ্ছে ৬২০ টাকা। অতিরিক্ত নিচ্ছে ১৩০ টাকা ৪০ পয়সা। ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৪২ কিমি, ভাড়া হওয়ার কথা ৪৩৫ টাকা ৬০ পয়সা। নেওয়া হচ্ছে ৫৭০ টাকা। অতিরিক্ত নিচ্ছে ১৩৪ টাকা ৪০ পয়সা। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে রাজশাহীর দূরত্ব ২৪৩ কিমি, ভাড়া হওয়ার কথা ৪৩৭ টাকা ৪০ পয়সা। নেওয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা। অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে ১৬২ টাকা ৬০ পয়সা। ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনার দূরত্ব ২২২ কিমি, ভাড়া হওয়ার কথা ৩৯৯ টাকা ৬০ পয়সা। নেওয়া হচ্ছে ৬৫০ টাকা। অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে ২৫০ টাকা ৪০ পয়সা। বুয়েটের এক জরিপে বলা হয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী শতকরা ৯৫ ভাগ বাস সিএনজিচালিত। ফলে এসব বাসের ভাড়া বৃদ্ধির কথা নয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দাবি, রাজধানীতে সিএনজিতে চলা বাসের সংখ্যা মোট বাসের মাত্র ৩.২৭ শতাংশ। অথচ, গতকাল বিভিন্ন এলাকায় ‘ডিজেলচালিত’ স্টিকার লাগানো বাসে সিএনজি ভরতে দেখা গেছে। ঢাকা থেকে নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মাওয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লাসহ কম দূরত্বের অনেক রুটেই সিএনজিচালিত বাস চলাচল করে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম এবং দূরপাল্লার পথে গ্যাসচালিত বাসেও বর্ধিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র পক্ষ থেকে মন্তব্য করা হয়েছে, এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো সরকারের জন্য ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও এটিকে ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।
সিপিডির এই মন্তব্যকে অনেকেই যৌক্তিক বলে মনে করছেন। কেননা, দেশে ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষিপণ্য উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়বে। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে। পাশাপাশি সার্বিকভাবে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহও হ্রাস পেতে পারে। এতে করে ডিজেল বিক্রি করে মুনাফা হলেও অন্যান্য খাত থেকে সরকারের আয় কমে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় না করার কারণে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসি ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি লাভ করেছে। তখন দেশে জ্বালানির দাম না কমিয়ে এখন কেন আন্তর্জাতিক বাজারের দাম বৃদ্ধি দেখিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তেলের মূল্য ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির পর বাসভাড়া ২৬ শতাংশ এবং লঞ্চভাড়া ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধিও অবাস্তব ধারণা থেকে করা হয়েছে। কারণ, তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বাসভাড়া শতকরা ৩ থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি হতে পারে। কিন্তু বাস মালিকদের সুবিধামতো বিআরটিএ কিলোমিটারপ্রতি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। তারপরও রাজধানীসহ নগর-মহানগর এবং এমনকি দূরপাল্লার পরিবহনগুলোতে সেই নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে আরো বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ফলে যাত্রীদের সঙ্গে ড্রাইভার, কন্ডাক্টরদের ঝগড়া-মারামারি হচ্ছে। বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করছে, স্টিকার লাগিয়ে সিএনজি ও গ্যাসের বাস চেনার ব্যবস্থা করছে। আর বাস মালিকরা দাবি করছে, তারা বেশি ভাড়া আদায়কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। প্রশ্ন হলো, এসব অভিযান ও তদারকি কতদিন চলবে? অভিযান-তদারকি বন্ধ হলেই আবার যে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাছাড়া দূরপাল্লার যানবাহনে দূরত্ব অনুপাতে যে ভাড়া হওয়ার কথা তার চেয়ে অতিরিক্ত যে ভাড়া বিভিন্ন পরিবহন নিচ্ছে তার প্রতিকারই-বা মিলবে কীভাবে? সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পুনর্নিধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় এবং যাত্রী ভোগান্তি থেকে বিরত না থাকলে, দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ফলে জনঅসন্তোষ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। বলাবাহুল্য, বিশ্বব্যাপী করোনাকারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে। এদেশেও অনেক মিল-কারখানা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরি এবং কর্ম হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। এই অবস্থায় জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিজনিত চরম দুর্ভোগ ও ক্ষতি থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে আমরা আশা করি। অন্তত নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা নিঁখুতভাবে কার্যকর করতে কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলে আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন