আমাদের দেশে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত একটি জ্বর। ডেঙ্গুর তেমন কার্যকরী প্রতিষেধক নেই। এ থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে একে প্রতিরোধ করা। তাই ডেঙ্গুজ্বর সচেতনতা সম্পর্কে আলোকপাত করছি। ডেঙ্গু কি? ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত একটি জ্বর। এডিস মশাবাহিত ৪ ধরনের ভাইরাসের যে কোনো একটির সংক্রমণে যে অসুস্থতা হয় সেটাই ডেঙ্গু। এর সাধারণত দু’টো ধরন রয়েছে। এক. ক্লিনিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর। দুই. হেমেরারেজিক ডেঙ্গুজ্বর বা হেমোরেজিক ফিভার। শেষেরটাই সবচেয়ে মারাত্মক হতে পারে। ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাস : ভাইরাসজনিত রোগের সাধারণত কোনো প্রতিষেধক নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্যসব ভাইরাল রোগের মতো এরও কোনো প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে এর মোকাবিলা করা হয়। অন্য ভাইরাল ফিভারের মতো এটিও আপনা-আপনিই সেরে যায় সাত দিনের মধ্যে। তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর ভয়াবহ হতে পারে।
ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ : হঠাৎ করে জ্বর। কপালে, গায়ে ব্যথা। চোখে ব্যথা, চোখ নাড়ালে এদিকে ওদিকে তাকালে ব্যথা। দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া। পায়খানার সঙ্গে রক্ত অথবা কালো কিংবা লালচে কালো রঙের পায়খানা এমনকি প্র¯্রাবের সঙ্গেও অনেক সময় রক্ত যেতে পারে। ডেঙ্গু হোমোরেজিক ফিভার খুবই মারাত্মক। মস্তিস্কেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। * শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ করে ১০৪ ডিগ্রি-১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। *গলা ব্যথা, চরম অবসন্নতা এবং বিষাদগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে। * অরুচি, বমি বমিভাব দেখা দিতে পারে। * রোগীর চোখ লাল হতে পারে এবং তকও লাল হতে পারে। *জ্বর ৩-৭ দিন স্থায়ী হয়। * শরীরের চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হয়। * সাধারণত জ্বর শুরু হওয়ার ৩-৪ দিন পর থেকে মারি দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণজনিত উপসর্গ দেখা যায় ত্বকে। চিকিৎসা : সত্যিকার অর্থে ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। উপসর্গ অনুযায়ী রোগের চিকিৎসা করা হয়। বেশিরভাগ ডেঙ্গুজ্বরই সাতদিনের মধ্যে সেরে যায়। অধিকাংশই মারাত্মক হয়। প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে পানি, বিশ্রাম এবং প্রচুর তরলখাবার। সঙ্গে জ্বর কমানোর জন্য কোনো মতেই প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ নয়। সাধারণ ডেঙ্গুর চিকিৎসা এই। তবে ব্যথানাশক ওষুধ হিসেবে এসপিরিন বা ক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ দেয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে। হেমোরেজিক বা রক্তক্ষয়ী ডেঙ্গু (যা খুবই কম হয়ে থাকে) বেশি মারাত্মক। এতে মৃত্যুও হতে পারে। জ্বর, সঙ্গে রক্ষক্ষরণের লক্ষণ দেখামাত্র হাসপাতলে ভর্তি করাতে হবে বিশেষ চিকিৎসার জন্য। জর কমানোর জন্য বারবার গা মোছাতে হবে ভেজা কাপড় দিয়ে। হোমোরেজিক ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো জরুরি। এ ক্ষেত্রে রোগীকে শিরাপথে রক্তের প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন করতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখা শ্রেয়। কারণ এসব রোগীকে কোনো স্বাভাবিক এডিস মশা কামড় দিলে সেই মশাটিও ডেঙ্গুর জীবাণু বাহক হয়ে পড়বে এবং তখন মশাটি সুস্থ কোনো ব্যক্তিকে কামড় দিলে সুস্থ ব্যক্তিটিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর রুগিকে ২ থেকে ২.৫ লিটার পানি নিশ্চিত করতে হবে। এই ডেঙ্গুর আসল চিকিৎসা। না খেতে পারলে স্যালাইন দিতে হবে। প্রতিরোধ ব্যবস্থা : ডেঙ্গু মশা মানে এডিস মশা সকাল সন্ধ্যায় কামড়ায়। অর্থাৎ ভোরে সূর্যোদয়ের আধাঘণ্টার মধ্যে এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের আধঘন্টা আগে এডিস মশা কামড়াতে পছন্দ করে। সুতরাং এই দুই সময়ে মশার কামড় থেকে সাবধান থাকতে হবে। সেই সাথে এডিস মশা নির্মূল করে ডেঙ্গুকে প্রতিহত করা যায়। যেসব স্থানে এডিস মশা বাস করে সেইসব স্থানের এডিস মশার আবাস ধ্বংস করে দিতে হবে। তাই দিনের বেলা ঘরে যাতে মশা ঢুকতে পারে না সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। জমে থাকা পানিতে এরা বংশ বিস্তার করে। ফুলের টব, কৃত্রিম পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, গাছের কোঠর, বাঁশের গোড়ার কোঠর, ডাবের খোসা, বাসার ছাদ প্রভৃতি স্থানে জমে থাকা পানিতে এদের বংশ বিস্তার ঘটে বলে সেখানটায় মশা নিধক ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারতে হবে। আর এভাবেই সম্ভব ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা। বাড়ির আশপাশের নর্দমা ও আবদ্ধ জলাশয়ে ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারতে হবে। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে। সর্বোপরি জনসেচতনতা সৃষ্টি এবং মশা ধ্বংসের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই দিনে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করুন এবং ডেঙ্গু হেমোরোজিক কীভাবে কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করুন।
ডা. মো. লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট
মোবা : ০৭১৬২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন