প্রতিদিনই দেশে বাড়ছে ডায়বেটিসের রোগীর সংখ্যা। পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডায়বেটিসের রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। ফলে এটি প্রতিরোধের সমন্বিত কর্মকান্ড জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে গতকাল বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস-২০২১ পালিত হয়েছে। এতে বিশেষজ্ঞরা এ সব কথা বলেন। গত ২০০৭ সাল থেকে এটি পালিত হচ্ছে জাতিসংঘ দিবস হিসেবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘ডায়াবেটিস সেবা নিতে আর দেরি নয়’। এ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
এদিন ডায়াবেটিস রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিত (বাডাস) বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক), ঢাকা শিশু হাসপাতাল এবং জেলা সিভিল সার্জন অফিস ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা দিবসটি পালন করে।
বাডাসের উদ্যোগে সচেতনতামূলক পোস্টার, লিফলেট বিতরণসহ সকাল সাড়ে ৮ টায় রোড শো (প্লাকার্ড হাতে সড়কের একপাশে দাঁড়িয়ে অবস্থান কর্মসূচি) পালিত হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে র্যালি পরিবর্তে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই অভিনব কর্মসূচি পালন করা হয়। এসময় সমিতির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন।
এ ছাড়া, সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবর, রমনা পার্কের গেটের পাশে এনএইচএন ও বিআইএইচএস’র বিভিন্ন কেন্দ্র সংলগ্ন স্থানে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় করা হয়। সকাল ১০টায় বারডেম মিলনায়তনে রোগী ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যে আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় বারডেম মিলনায়তনে আলোচনাসভা হয়।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে দ্রুত নগরায়নের ফলে রাস্তা-ঘাট, খেলার জায়গা কমে যাচ্ছে। এতে শিশু থেকে শুরু করে বড়দের কায়িক পরিশ্রম কমে যাচ্ছে। এছাড়া আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মানুষের খাদ্যাভাস ও জীবনযাপনে পরিবর্তন আসছে। এসব কারণে শারীরিক জটিলতা ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ছে। এ ব্যপারে এখন সচেতন হয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। দেশে ডায়াবেটিস রোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি (বাডাস) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাদের মত অন্যান্যদের এভাবে রোগটি সমম্পর্কে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার ।
এদিকে বিএসএমএমইউ’র এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়বেটিস অ্যান্ড হরমোন) বিভাগের উদ্যোগে সেমিনার, শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধনসহ ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়েছে। বিএসএমএমইউ’র এ ব্লকে আয়োজিত এক সেমিনারে বিভিন্ন অনুষদের ডিন, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
এসময় ভিসি প্রফেসর ডা. শারফুদ্দীন আহমেদ বলেন, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার কারণে অনেক সময় মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। শরীর দুর্বল হয়ে যায়, হার্ট, কিডনী, লিভারসহ রোগীরা বিভিন্ন জটিলতায় ভোগেন। তবে মানুষ সচেতন হলে এই রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুবিক জটিলতা নির্ণয় ও চিকিৎসা বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শেখ মাহবুব আলম। এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম উল্লেখ করেন, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডায়বেটিসের রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। ফলে এটি প্রতিরোধের সমন্বিত কর্মকান্ড জোরদার করতে হবে। গাইনোকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সঠিক পরিচর্যা জরুরি।
এছাড়া সকালে সাড়ে নয়টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। শোভাযাত্রাটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা ঘুরে ঢামেক-২ এর সামনে এসে শেষ হয়। এরপর সকাল ১০টায় একটি বিশেষ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) এর একটি জরিপের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশের মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লক্ষ। এদের মধ্যে ১৮-৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লক্ষ। বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে অন্যতম। ডায়াবেটিস একটি প্রতিরোধ যোগ্য রোগ। কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার পর তা নিয়ন্ত্রণে না রাখলে রোগীর মস্তিস্ক, হার্ট, কিডনি এবং চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই ফ্রি ডায়াবেটিস স্কিনিং এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছিল এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ।
এছাড়া সেরকারি ওষুধ কোম্পানী বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সানোফি বাংলাদেশ গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে বৈজ্ঞানিক সেমিনার করে। সেমিনারে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের বর্তমান পরিস্থিাতি আলোচনা, ভবিষ্যৎ দিক-নির্দেশনা এবং তরুণ গবেষকদের সংবর্ধনা দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে, আমাদের অনেক তরুণ গবেষক আছেন, যারা নিজ নিজ চিকিৎসা ক্ষেত্রে মুল্যবান অবদান রাখার পাশাপাশি বৈশ্বিক ডায়াবেটিস ব্যবস্থাাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। এবার বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপরক্ষ্যে, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সানোফি বাংলাদেশ ডায়াবেটিস ক্ষেত্রে শীর্ষ তরুণ গবেষকদের সংবর্ধনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়। এই প্ল্যাটফর্মটি তরুণ গবেষকদের তাদের কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের জন্য স্বীকৃতি দেয়ার পাশপাশি গবেষকদের ডায়াবেটিসের মত চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রে আরও বেশি কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সেরা ৫ বিজয়ী গবেষকের নাম ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর ২০২১ সালের মধ্যে গবেষকেদের প্রকাশনার ভিত্তিতে বিজয়ীদের নির্বাচন করা হয়।
ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা বিশেষ ওয়েবিনারের আয়োজন করে। মহামারিকালীন ডায়বেটিক রোগীদের বিশেষ যত্নে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়ে বিশেজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ অনেক উন্নত হয়েছে। তবে আমরা যারা ওষুধ প্রেসক্রাইব করছি, তাদের উচিত রোগীর ধরণ বুঝে ওষুধ দেয়া। বর্তমানে ইনহেল্ড ইনসুলিনও চলে এসেছে, যদিও তা আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী নয়। আমরা আশা করছি অচিরেই এমন ইনসুলিন চলে আসবে যেটি সপ্তাহে একদিন দিলেই ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন