শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হোক

প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবনের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কায় আবারো ইউনেস্কো এবং আইইউসিএন রামপাল প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এই প্রকল্প গ্রহণের শুরু থেকেই ইউনেস্কোসহ দেশী-বিদেশী পরিবেশবাদীরা আপত্তি প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনের শেলা নদীতে তেলবাহী টেঙ্কার ডুবে হাজার হাজার গ্যালন তেল ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন ব্যাপক পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পরও প্রস্তাবিত রামপাল প্রকল্পসহ সকল কমার্শিয়াল নৌযান এবং শিল্পায়ন কার্যক্রম বন্ধ করার দাবী জানিয়েছিল বিভিন্ন সংস্থা। চলতি বছরের মার্চ মাসে ইউনেস্কোর একটি প্রতিনিধিদল সুন্দরবন পর্যবেক্ষণ শেষে আগস্ট মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়েছে, রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সেই প্রতিবেদনের জবাবও দেয়া হয়েছে। এরপর ইউনেস্কো এবং আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার) আবারো রামপাল প্রকল্প সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আগামী পহেলা ডিসেম্বরের মধ্যে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সুন্দরবনের স্পর্শকাতর অঞ্চলে প্রস্তাবিত রামপাল কয়লাবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পরিবেশবাদী গ্রুপ শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসলেও বিস্ময়করভাবে সরকার তার অবস্থানে অনড় রয়েছে। তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকদের দ্বারা গঠিত একটি সংগঠন হিসেবে পরিচিত হলেও তার রামপাল প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন এখন গণমানুষের ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করেছে। ইতিপূর্বে রামপাল বিরোধী রোডমার্চসহ নানা কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে। পাশাপাশি এরই মধ্যে বিএনপিও রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র সরিয়ে নেয়ার দাবীতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে।
দেশে বিদ্যুতের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, এ প্রেক্ষাপটে কয়লাভিত্তিক নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। তবে বাংলাদেশের জন্য সুন্দরবনের ভূ-প্রাকৃতিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিদ্যুত কেন্দ্রের চেয়ে অনেক বেশী। মূলতঃ সুন্দরবনের গুরুত্ব অর্থনৈতিক বিচারে পরিমাপযোগ্য নয়। রামপাল প্রকল্পে যত উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হোক, প্রকল্পের ঝুঁকি থেকে সুন্দরবনকে বাদ রাখাই হচ্ছে মূল কথা। প্রতিদিন শত শত টন কয়লা পোড়ানোর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কথা বাদ দিলেও সুন্দরবনের কাছে বিদ্যুতকেন্দ্র ও ও ভারী শিল্প স্থাপনের কারণে প্রচুর সংখ্যক বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের কারণে তেলবাহী টেঙ্কারসহ কয়লা, পাথর ও কেমিকেলবাহী নৌযান ডুবিতে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের জীববৈচিত্র্য ইতিমধ্যেই হুমকির মুখে পড়েছে। সরকার আগামী ২০২১ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুত উৎপাদন দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। বিদ্যুত উৎপাদনের নানামুখী উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে এই লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়। বৃহত্তর স্বার্থে রামপাল প্রকল্প নিয়ে সরকারের অনড় অবস্থান গ্রহণ করা সমীচীন নয়। ইতিপূর্বে আন্তর্র্জাতিক রামসার কনভেনশনের তরফ থেকেও সুন্দরবনের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম ও প্রাণবৈচিত্র্যময় ম্যানগ্রোভ বন, বিরল বৈশিষ্ট্যের বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, ইরাবতি ডলফিন, বিরল প্রজাতির মাছ শিকারী ঈগল, রিভার টেরাপিন (কচ্ছপ) সহ নানা প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে সুন্দরবন রামসার কনভেনশন এবং ইউনেস্কো ও আইইউসিএন’র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে ইউনেস্কোর আগামী অধিবেশনে সুন্দরবনকে একটি ঝুঁকিপূর্ণ হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করতে পারে বলে জানা গেছে।
দেশী-বিদেশী সকল পরিবেশবাদী সংগঠন, সংস্থা এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম দাবীদার সুন্দরবনের ক্রিটিক্যাল অঞ্চলে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মিত হলে এই বনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে বলে মত দিয়েছেন। সকল মতামত, প্রতিবাদ ও গণদাবী উপেক্ষা করে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাওয়ার কোম্পানী নাম দিয়ে ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানী এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়ী অবনতি হবে বলেও অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। রামপাল প্রকল্প বন্ধের দাবী এখন শুধু বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ, প্রধান রাজনৈতিক দল এবং ইউনেস্কো, রামসারসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এমনকি ভারতের নাগরিক সমাজের কিছু প্রতিনিধি ও পরিবেশবাদী সংগঠনও এই দাবীতে সোচ্চার হয়েছে। গত মঙ্গলবার ঢাকায় তেল-গ্যাস কমিটি রামপাল প্রকল্প বন্ধের দাবীতে একটি র‌্যালিসহ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি খোলা চিঠি ভারতীয় হাই কমিশনে হস্তান্তরের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে ব্যাপক পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। একই দিনে ঠিক একই দাবীতে ভারতেও অল ইন্ডিয়া ইউনিয়ন অব ফরেস্ট ওয়ার্কিং পিপল এবং ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব পিপল্স মুভমেন্ট (এনএপিএম) নামের দু’টি পরিবেশবাদী সংগঠনের তরফ থেকে যৌথভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে লেখা একটি চিঠি হস্তান্তর করা হয়েছে। রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলে তার নেতিবাচক প্রভাব ভারতীয় অংশেও পড়বে বলে তদের চিঠিতে বলা হয়েছে। ইতিপূর্বে কয়েকটি ভারতীয় সংগঠন রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। অন্যদিকে প্রবীণ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের অংশ বলে মন্তব্য করেছেন। কোন জেদ ও এক্সপেরিমেন্টের বশবর্তী না হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভানেত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামপাল প্রকল্প নিয়ে নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, এই প্রত্যাশা সকলের। রামপাল প্রকল্প অন্যকোন স্থানে সরিয়ে নেয়ার কোন বিকল্প নেই।

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Shahabuddin Akand ২০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০৪ পিএম says : 0
রামপাল ব‌ি‌দ্যুৎ ক‌ে‌ন্দ্র বন্ধ কর‌ে দে‌য়া হ‌োক ।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন