বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অনেক সাফল্য দৃশ্যমান। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা হলো প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভের আগে ছয় বছরের কম বয়সের শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা। ৩ থেকে ৫-৬ বছর বয়সী শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তাদের যত্নে বেড়ে ওঠা এবং শিশুর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। খেলাধুলা, আনন্দের, মধ্য দিয়ে অক্ষরজ্ঞান এবং গণনার হাতেখড়ি দেয়াই এ ব্যবস্থার লক্ষ্য। শিশুর শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কৌশল এই ধাপ। স্কুল ও প্রতিদিনকার জীবনযাপনে সফলতা আনার জন্য শিশুকাল থেকেই দক্ষতা এবং আচরণ শেখানোর জন্যই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার আয়োজন। এই মাধ্যমে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগী করে গড়ে তোলাসহ সব ধরনের উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার আরও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো, প্রতিষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি ঝোঁক তৈরি করা, শিশুদের মানসিক ও শারীরিকভাবে শিক্ষাগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করা, শিশুদের উপযোগী খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের সামাজিকীকরণ শিক্ষা, নাচ-গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, গল্প বলা, গণনা করা, বর্ণমালা শিক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষতা ও আত্ববিশ^াসী হিসেবে গড়ে তোলা। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব এবং শিশুদের উপযুক্ত যত্ন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর ফলে দিবাযত্নকেন্দ্র এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে।
কুদরত-ই-খুদা (১৯৭৪) এবং মফিজউদ্দিন আহমেদ (১৯৮৮)-এর নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন শিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে সুপারিশ করেছিল। দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলনের জোর সুপারিশ করে এই দুই কমিশন। এই শিক্ষা কমিশন প্রথম শহর ও শিল্প এলাকায় যেসব শিশুর অভিভাবক বাইরে কাজ করেন, সেসব শিশুর জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের সুপারিশ করে। মফিজউদ্দিন আহমেদ কমিশনের সুপারিশ ছিল- সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণি খোলার। ১৯৯৫ সালে গঠিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য শিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে আরও কিছু সুপারিশও পেশ করে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৯৭ সালে গঠিত কমিটিও সুপারিশ করে, শিশু প্রথম শ্রেণির প্রথম ছয় মাস প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করবে, এমন সুপারিশ ছিল এই কমিশনের। বর্তমান সরকার সে লক্ষ্যে পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। প্রাক-প্রাথমিক শিশুদের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে দেশের অনেক শিশুই সরকারি প্রাক-প্রাথমিক ক্লাসে যোগদান করছে। যেসব শিশুর অভিভাবক কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্য শিক্ষিত নন, এমন অনেক শিশু প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নানা বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছে।
প্রায় ৩৮,০০০ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি কার্যক্রম চলমান। অদুর ভবিষ্যতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই এ কার্যক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। যথাযথ প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় সহায়কসামগ্রী দিয়ে এসব বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। দেশব্যাপী কোনো জরিপ পরিচালনা করা হয়নি বলে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তিকৃত শিশুর সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। ৩৮,০০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গড়ে ৫০ জন শিশু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১.৯ মিলিয়ন, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা শতকরা ২৪ ভাগ। অবশ্যই এ সংখ্যাই শেষ নয়। দেশের বিরাট অংশের শিশুরা বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন কিংবা এনজিওর বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করছে। ১৯৯৮ সালে জাতীয় পাঠ্যক্রম বোর্ড (এনসিটিবি) প্রাক-প্রাথমিকের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে।
বর্তমানে দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনামূলক নীতিমালা রয়েছে। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে শিশুদের অনানুষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা, গণনা ইত্যাদি শিক্ষাদান করা হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত যদি ১:৫০ হয়, তাহলে শিশুদের শিক্ষক সংখ্যা হয় ৪৮ হাজার। তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষকই প্রশিক্ষিত। স্নাতক এবং কখনও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষক শিশুদের শিক্ষাদানে নিয়োগ করা হয়। তাদের অধিকাংশই নারী। ২০০০ সালের পর প্রায় প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু করা হয়েছে। ২০০৫ সাল নাগাদ এই ব্যবস্থা এক বছর মেয়াদে চালু করা হয়। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারিভাবে প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছয়টি করে নতুন শ্রেণিকক্ষ এবং ছয়জন শিক্ষক নিয়োগ করেছে। শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা গ্রহণের ফলে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করার জোর প্রচেষ্টা চলছে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। প্রতি বছর ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক দিবস পালন করা হচ্ছে। এদিন সারাদেশে একযোগে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে পূর্ণ সেট বই বিতরণ করা হয়। ২০১০-২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৬০ কোটি ৮৬ লাখ ৯১ হাজার ২৯০ কপি পাঠপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে সর্বপ্রথম প্রাক-প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠীর ৮২ হাজার ৮৯৬ শিক্ষার্থীর মাঝে নিজ নিজ মাতৃভাষায় মুদ্রিত দুই লাখ ২৬ হাজার ৫৫৯টি পাঠ্যবই বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে।
স্বাধীনতার পরপর দারিদ্র্যবিমোচন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথে জনসংখ্যার আকার প্রধান বাধা বলে চিহ্নিত হয়েছিল। গ্রামীণ জনপদ ও দারিদ্র্য উপেক্ষা করার ঔপনিবেশিক মনস্তত্বের গণ্ডি পেরিয়ে আমজনাতার দোরগোড়ায় রাষ্ট্রীয় শিক্ষাসেবার সুযোগ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন একটা গণমুখী শিক্ষা কাঠামো প্রবর্তনের লক্ষ্যে যুগোপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত হয় তখনই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০৩০ সালের মধ্যে মানসম্পদ শিক্ষার অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ার নতুন চ্যালেঞ্জ প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এসডিজি-৪ নির্ধারণ করেছে শিক্ষার কাক্সিক্ষত মান অর্জনের লক্ষ্য। সংখ্যা নয়, গুণগতমানই হবে শিক্ষার মাপকাঠি। বর্তমানে রাঙামাটি, বান্দারবান ও খাগড়াছড়ি এ তিনটি জেলায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দুই বছর মেয়াদে চালু আছে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশুরা অনেক ভালো করছে। এই শিক্ষা-পরবর্তী জীবনেও সফলতা আনছে। দেশে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থাও শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। এ জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় অনেক সাফল্যও আসছে।
ইউনিসেফের সহযোগিতায় ব্র্যাক শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে অনেক কাজ করেছে। বর্তমান সরকার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে অনেক কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে। দেখা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিল্প এলাকায় অনেক উপকারে আসে। শিল্পাঞ্চলের কর্মজীবী মায়েরা সকালে শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে কাজে চলে যান। শিক্ষাঙ্গনে শিশুটি অনেক আনন্দে থাকে। সহপাঠী অন্যদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারে মনের আনন্দে। পাশাপাশি অনেক কিছু শিখতে পারে খেলার সাথে। সাতক্ষীরা জেলার অভিভাবকদের নিয়ে একটি গবেষণা চালানো হয়। শিক্ষকদের নীতি ও অনুশীলন নিয়ে সেখানে কাজ করা হয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে অভিভাবকদের অভিমত। তাদের মতে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ ভালো। শ্রেণিকক্ষ সুন্দর। শিশুদের বিনোদন ও শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণই রয়েছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। শিশু একাডেমির নানামুখী কার্যক্রম এখনও চলমান। পাশাপাশি খেলাধুলা, সংগীত চর্চা, চিত্রাঙ্কনেও সফলতা দেখাচ্ছে এসব শিশুরা। এসব কারণে প্রাক-প্রাথমিকে শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণে শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আবেগ-অনুভূতির বিকাশ সাধন হচ্ছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে।
লেখক: নিবন্ধকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন