শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

গণমুখী প্রশাসনের বিকল্প নেই

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২২ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৭ এএম

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২১(২)-তে বলা হয়েছে যে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ প্রশ্ন ওঠে, জনগণ কি প্রশাসন বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি অর্থাৎ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিকট থেকে কাক্সিক্ষত সেবা প্রাপ্ত হচ্ছে? জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে তারতম্য এই যে, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, অন্যদিকে জনগণ প্রশাসন দ্বারা শাসিত হচ্ছে। শাব্দিক অর্থে জনগণ রাষ্ট্রের মালিক এবং প্রশাসনে নিযুক্তরা জনগণের বেতনভুক্ত কর্মচারী। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১)-তে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোই প্রশাসনের একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাস্তবে কি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো হচ্ছে? বাংলাদেশের পূর্বাপর ইতিহাস অনেক কণ্টকময়। এ দেশের জনগণের সাথে ১৯০৫, ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৮০ প্রভৃতি সাল সহ অনেক অনেক ঘটনা রয়েছে, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক ঘটন-অঘটনের পরও জনগণের ভাগ্যের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন হয়নি, বরং কোথাও কোথাও জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

রাজা, রাজত্ব, সাম্রাজ্য, রাষ্ট্র প্রভৃতির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই প্রশাসনের সৃষ্টি। কারণ, শাসক গোষ্ঠি জনগণকে শায়েস্তা ও আজ্ঞাবহ রাখার জন্য প্রশাসন নামান্তরে লাঠিয়াল বাহিনী বা রাজকর্মচারীদের ব্যবহার করতো। রাজত্ব চলতো জনগণ থেকে আদায়কৃত খাজনা থেকে। খাজনাই ছিল রাষ্ট্রের বা রাজত্বের বা সাম্রাজ্যোর আয়ের একমাত্র উৎস, যা প্রকারন্তরে হালে ট্যাক্স বা কর নামে রূপান্তরিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক প্রতি জেলায় রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। প্রকৃতপক্ষে জেলা প্রশাসকের আদি পদবী কালেকটর। কালেকটরের বাংলা অর্থ হচ্ছে সংগ্রহকারী ব্যক্তি বা সংগ্রাহক। জেলা প্রশাসকদের মূল কাজ ছিল এবং বর্তমানেও হচ্ছে ভূমিকর বা খাজনা আদায় পরবর্তীতে প্রশাসনিক দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, কর্পোরেশনের সৃষ্টি করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় সেবা জনগণের দরজায় পৌঁছে দেয়ার জন্য। রাষ্ট্রীয় কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন পদে, বিভিন্ন শ্রেণিতে বিন্যাস করা হয়েছে, প্রকারান্তরে তারা আমলা, গোমস্তা প্রভৃতি নামকরণেও ভূষিত হয়েছিল। বৃটিশ আমলে ভারতীয়দের শাসন-শোষণের মাধ্যমে রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রশাসনিক অবকাঠামো সৃষ্টি করা হয়, যা এখনো সেই আদলেই চলছে। জনতার চাহিদার প্রয়োজনে দেশ দুই বার স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু আমলাতন্ত্রের মানসিকতা ও ধরন পরিবর্তন হয়নি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন গণপরিষদ শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরু করে। ২ মার্চ পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল নতুন শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষর করেন, যা ২৩ মার্চ বলবত হয়। এতে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়। অতপর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।

বলা হয়, জনগণের কল্যাণের জন্য প্রশাসন, যা অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ক্যাডার হিসাবে পরিচিত। এ ক্যাডার বাহিনী ঔপনেবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে উপমহাদেশকে কীভাবে শাসন-শোষণ করা যায় সে আদলে ও মানসিকতায় শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে। বৃটিশরা আমাদের শাসন-শোষণ করতো তাদের প্রশাসনিক ক্যাডার বাহিনী দ্বারা এবং এ বাহিনীই সেবার পরিবর্তে ঘুষ প্রথা বৃটিশ ইন্ডিয়াতে চালু করেছে, যা পরবর্তীতে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা বইতে (পৃষ্ঠা-২৯) লেখক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান লিখেছেন যে, ‘উৎকোচ নামক দুর্নীতি এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে আমদানি করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা ১৯৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশ বৎসরে ষাট লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছিল (সূত্র: Fourth Parliamentay Report 1773, Page-535, সুপ্রকাশ রায় প্রণীত ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ থেকে সংগৃহিত)।

বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনে ইংরেজরা একা ছিল না। তাদের পাশে ছিল তাদের এদেশীয় দালাল, গোমস্তা ও বেনিয়াগোষ্ঠি তথা প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত উপমহাদেশের সন্তানেরা। তাদের শোষণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা সম্পর্কে কট্টর সাম্রাজ্যবাদী লর্ড মেকলে স্বয়ং মন্তব্য করেছেন, ‘কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের প্রভূ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নয়, নিজেদের জন্য, প্রায় সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশি লোকদেরকে তারা অত্যন্ত কম দামে উৎপন্ন দ্রব্য বেচতে এবং অন্যদিকে খুবই চড়া দামে বিলাতী পণ্য কিনতে বাধ্য করতো। কোম্পানি তাদের অধীনে একদল দেশীয় কর্মচারী নিয়োগ করতো। এই দেশীয় কর্মচারীরা যে এলাকায় যেতো, সে এলাকায় ছারখার করে দিতো। সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো। ব্রিটিশ কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার উচ্চপদস্থ (ইংরেজ) মনিবের শক্তিতে বলিয়ান। আর এই মনিবদের প্রত্যেকের শক্তির উৎস ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। (তাদের ব্যাপক লুণ্ঠন ও শোষণের ফলে) শীঘ্রই কলকাতায় বিপুল ধন-সম্পদ স্তূপীকৃত হলো। সেই সাথে তিন কোটি মানুষ দুর্দশার শেষ ধাপে এসে দাঁড়ালো। বাংলার মানুষ শোষণ ও উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যস্থ একথা ঠিক, কিন্তু এ ধরনের (ভয়ংকর) শোষণ ও উৎপীড়ন তারাও কোনদিন দেখেনি’ (সূত্র: Macaulay: Essays on Lord Clive, P-63)।

দেশ ও জাতির কল্যাণ যদি প্রশাসনের একমাত্র দায়িত্ব হয়ে থাকে তবে জনগণের প্রতিটি পদে পদে এতো ভোগান্তি হয় কেন? প্রশাসন প্রদত্ত সেবায় কি এদেশের সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট বলে প্রতিয়মান হয়? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঘুষের যে প্রথা চালু করেছিল, পর পর দুইবার স্বাধীন হওয়ার পরও কি দেশ ঘুষ মুক্ত হয়েছে? এখনো সাধারণ জনগণের সাথে আমলাতন্ত্রের যে ব্যবহার ও আচরণ তাতে কি তাকে গণমুখী প্রশাসন বলে মনে হয়? বৈষয়িক উন্নয়ন এবং মানুষের সাংবিধানিক অধিকার পাওয়া কি এক কথা? উন্নয়নের ক্রমধারা দেশের জনগণ যদি একই ধারাবাহিকতায় ভোগ করতে পারে, তাকেই বলা যেতে পারে সার্বিক উন্নয়ন।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, দেশের কোন শ্রেণির মানুষ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে? উত্তর নিশ্চয় গণমানুষের পক্ষে আসবে না। চুলচেরা বিচার করলে অবশ্যই দেখা যাবে যে, আমলারা রয়েছে সুখে-শান্তিতে, জনগণ রয়েছে ভোগান্তিতে, যাদের উপরে সরকারি দলের ছায়া নেই। যারা সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে তারাই পাচ্ছে রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে যে প্রশাসনকে জনগণের অর্থে রাষ্ট্র লালন পালন করে সেই প্রশাসন তথা আমলারা দেশকে পরিষ্কারভাবে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। যথা (১) ক্ষমতাসীন গোষ্ঠি, (২) ক্ষমতা বহির্ভূত গোষ্ঠি, যারা ক্ষমতার সাধ থেকে বঞ্চিত। হালে বাংলাদেশে একই আইন দু’ভাবে প্রয়োগ হয়। এতে ক্ষমতাসীনরা থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে এবং যত আইন কার্যকর হয় শুধুমাত্র ক্ষমতাহীনদের বেলায়, যাদের খুঁটির জোর নেই।

প্রশাসনকে গণমুখী করা বা গণমুখী প্রশাসন সৃষ্টি করার প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ, যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার পরিচয় দেবেন। তারা এক চোখে তৈল, অন্যচোখে লবণ বিক্রি করবেন না।

একটি গণমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থা কোনো কারণেই জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে যথাযথ সম্মান পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে না। কিন্তু হালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা প্রশাসন দ্বারা অসহায় জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপ-মহাদেশে যে ঘুষ প্রথা ও তাবেদারীর শিক্ষা দিয়েছে, প্রশাসনকে গণমুখী করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই জনগণ কাক্সিক্ষত সেবা ও সম্মান পাওয়া থেকে বঞ্চিত। স্বাধীনতার সুফল জনগণের দরজায় পৌঁছানোর জন্য একটি গণমুখী প্রশাসনের বিকল্প নাই।

লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন