শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বখাটে-সন্ত্রাসীদের রুখতে হবে

প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রাজধানীসহ সারাদেশে একশ্রেণীর উঠতি তরুণ ও বখাটে-সন্ত্রাসীর উৎপাত বেড়েই চলেছে। এসব সন্ত্রাসীর হাতে একেকটি নির্মম, নৃশংস ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়, সন্ত্রাসীদের শাস্তির দাবীতে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়; নানা রকম দাবী তোলে, মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়, সরকারের মন্ত্রী-এমপি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তারা কিছু গালভরা বুলি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর দোষারোপ অথবা শীঘ্রই অপরাধীদের শায়েস্তা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। অতঃপর পরের ভয়ঙ্কর ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সবকিছু যেন স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে। এভাবেই ন্যক্কারজনক ঘটনার দৃষ্টান্ত বেড়ে চলেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তার রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবের সুযোগ নিয়ে পেশাদার অপরাধী এবং সরকারী দলের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী ক্রমে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের হাতে সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তারের নির্মম-রক্তাক্ত হামলার শিকার হওয়ার ঘটনা এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যতম আলোচিত বিষয়। এর মাঝেই দেশের বিভিন্ন স্থানে একই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। গতকাল ইনকিলাবসহ বিভিন্ন সহযোগী দৈনিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বখাটে-সন্ত্রাসীদের হাতে ছাত্রী ও নারীদের লাঞ্ছিত হওয়ার অনেকগুলো ঘটনার সংবাদ ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ করায় কলেজ ছাত্রী দুইবোন বখাটেদের হামলার শিকার। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে বখাটে যুবকরা তাহমিনা আক্তার নামের এক স্কুল ছাত্রীকে তার বাড়িতে গিয়ে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেছে। দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে ১৪ বছর বয়েসী স্কুলছাত্রী জাকিয়া সুলতানা বখাটে-সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে আহত হওয়ার পর সেখানকার মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে। বোচাগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বখাটেদের ইভ-টিজিং বিরোধী এবং খাদিজা আক্তারের উপর হামলাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবীতে মানববন্ধন হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে এক স্কুল ছাত্রী নিখোঁজ হওয়ার পর দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও তার কোন সন্ধান পায়নি পুলিশ। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই এমন ঘটনার সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করলেও বখাটে-সন্ত্রাসীদের উৎপাত বেড়ে যাওয়া এবং সারাদেশে বিশেষত ছাত্রী-নারী ও নিরপরাধ সাধারণ মানুষ আক্রান্ত, খুন ও গুম হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত জিরো টলারেন্স সামাজিক অপরাধ দমনে তেমন কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারছে না। জঙ্গি দমনের কথিত অভিযান ও নজরদারির ব্যবস্থার ফলে বিদেশি নাগরিক ও বিশেষ বিশেষ দিবসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও সাধারণ মানুষ যেন ক্রমেই বখাটে তরুণ ও দলীয় পরিচয়ধারী সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে। একদিকে র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা মারা যাচ্ছে, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান হারে সারাদেশে বখাটেদের হাতে নারীরা লাঞ্ছিত, নিহত হচ্ছে। দলীয় কোন্দলে সরকারী দলের নেতা-কর্মীদের হাতে অস্ত্রের ঝনঝনানিও কমছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে মাটি খুঁড়ে জঙ্গিদের খুঁজে বের করার কথা বলা হলেও এরা প্রকাশ্য অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা ও চাঁদাবাজি করছে, যখন তখন প্রকাশ্য হুমকি দিচ্ছে। এঁদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করতেও ভয় পায় সাধারণ মানুষ। পুলিশ এদের দেখেও দেখে না। সরকারী দলের পরিচয়ধারী বখাটে-সন্ত্রাসীদের সাথে পুলিশের একশ্রেণীর কর্মকর্তার সখ্য ও বোঝাপড়ারও অভিযোগ আছে।
সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ছাড়া কোন জাতি তার উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। আমাদের সরকার আগামী দশকে একটি মধ্য আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার রাজনৈতিক রেটরিক প্রচার করলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধুমাত্র জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব দিয়ে জাতির উন্নয়ন অগ্রগতির হিসাব চলেনা। কুমিল্লায় সোহাগি জাহান তনু সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হওয়ার পর সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নানা ধরনের উদ্যোগ ও তৎপরতা নিতে দেখা গেছে। তবে ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও তনুর হত্যাকারীরা বিচারের আওতায় আসেনি। নিহতের স্বজনরা এখন তদন্ত ও বিচারের ভবিষ্যত নিয়ে চরমভাবে হতাশ। এভাবেই পার পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে ঘাতক-সন্ত্রাসীরা। অপরাধের রাজনীতিকীকরণ এবং ব্লেইম গেমের কারণে একদিকে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও পুলিশের ব্যর্থতার কারণে উঠতি তরুণদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নিয়োগের কারণে পুলিশের মধ্যেও অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। পুলিশের একশ্রেণীর কর্মকর্তার মাদক এবং অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ার খবরও মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে। রক্ষকরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণেই এখন সামাজিক অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, মাদকাসক্তি, সামাজিক অবক্ষয়, ইভ-টিজিং, নারী ও শিশু নির্যাতন অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায় সব ধরনের সন্ত্রাসী-অপরাধী ও বখাটে তরুণদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন