আগামীকাল শনিবার ২২শে অক্টোবর বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী জাতীয় কাউন্সিল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২২শে অক্টোবর সম্মেলনটি শুরু হয়ে ২৩ অক্টোবর শেষ হবে। এটি হবে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪শে জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জন্মগ্রহণ করে সেদিনের পূর্ব বঙ্গ আওয়ামী মুসলিম লীগ। তারপর ৬৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ৬৭ বছর পরেও সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ দাপটের সাথে টিকে আছে এবং এখন পাকিস্তান আমলে সরকার পরিচালনা করছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। তখন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের মাত্র ১৩ জন সদস্য ছিলেন। ১৩ জন সদস্য নিয়ে সোহরাওয়ার্দী যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন, ড. খান সাহেবের রিপাবলিকান পার্টি সমর্থন প্রত্যাহার করায় ১৩ জন সদস্য সমর্থিত সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা মাত্র ১৩ মাস স্থায়ী হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো আওয়ামী লীগও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের সমালোচনা থাকবেই। আর সেটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৌন্দর্য্য। তবে সকলেই স্বীকার করবেন যে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও জন্মের পর থেকে ৬৭ বছরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল মিলে আওয়ামী লীগ মাত্র সাড়ে ১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলো এবং আছে। এর মধ্যে পাকিস্তান আমলে ২৪ বছরে মাত্র ১৩ মাস আর বাংলাদেশ আমলে ৪৬ বছরে মাত্র ১৬ বছর। অন্য কথায় ৬৭ বছরের মধ্যে ৫০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে সবগুলো রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাংগঠনিক দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে শক্তিশালী এবং কর্মী বাহিনীর দিক দিয়ে বৃহত্তম।
প্রাসঙ্গিকভাবে পুনরায় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ আমলে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর প্রথম সরকার গঠন করে এবং সেই সরকারের স্থায়িত্ব ছিলো ৩ বছর ৮ মাস। এর পর ১৯ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিলো। অতঃপর, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ঐ মন্ত্রিসভা ৫ বছরের মেয়াদ পূরণ করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ তৃতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করে। সেটিও ৫ বছরের মেয়াদ পূরণ করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ চতুর্থ মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং আজও সেই মন্ত্রিসভা ক্ষমতাসীন রয়েছে। এই বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের ৪৬ বছরের জীবনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলো এবং রয়েছে ১৬ বছর এবং ক্ষমতার বাইরে রয়েছে ৩০ বছর। আর পাকিস্তান আমলে ২৪ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় ছিলো মাত্র ১ বছর ১ মাস। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলে আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকে দলটি ক্ষমতায় ছিলো ১৭ বছর এবং ক্ষমতার বাইরে ছিলো ৫০ বছর। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ যতদিন ক্ষমতার বাইরে ছিলো ততদিন সেটি ছিলো দলটির জন্য সোনালী যুগ। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ প্রধান যে দুটি ইস্যু বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করেছে সেই দুটি ইস্যু হলো পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। দ্বিতীয়টি হলো সারা পাকিস্তানে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপোষহীন অবস্থান গ্রহণ করায় সোহরাওয়ার্দীকে বলা হতো ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’। আর পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায় এবং চূড়ান্ত পরিণামে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী আখ্যায়িত করেছে জাতির পিতা ও বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে। বস্তুত স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা ছিলো আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের অহংকার। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা অঙ্কন করতে গিয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। অর্থাৎ সকলের সাথেই বন্ধুত্ব এবং কারো সাথে শত্রুতা নয়। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আওয়ামী লীগ আজ একনাগাড়ে ক্ষমতায় আছে এবং যতই দিন যাচ্ছে ততই তার ক্ষমতা সংহত হচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ নাই। রাজনীতির ক্ষেত্রে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী সরকার। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সরকার যেটাই চিন্তা করছে সেটাই বাস্তবায়ন করছে। এই একচ্ছত্র ক্ষমতা আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে একটি বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে। আর সেটি হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ, জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন এবং পররাষ্ট্রনীতিকে বহুমুখী করা। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে বিরোধী দলে থাকার সময় আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের জন্য শুধুমাত্র উচ্চকণ্ঠই ছিলো না, মাঠে ময়দানেও তাকে লড়াই করতে হয়েছে। এই জাতির দুর্ভাগ্য যে, দেশের সবগুলো বিরোধী দলকে আজ সেই গণতান্ত্রিক অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠার জন্যই লড়াই করতে হচ্ছে। আসন্ন কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠানের জন্য আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ব্যবহার করছে। সম্মেলন উপলক্ষে রাজধানীর অনেকগুলো রাস্তা ঘাটে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই ধরনের অনেক প্রশাসনিক, নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছে আওয়ামী লীগ। তার এই অধিকার ভোগে কারো কোনো ঈর্ষা নাই। কিন্তু কাউন্সিলের নেতা ও কর্মীরা যদি শপথ নেন যে, আগামীতে বিরোধী দলগুলোকেও অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে তাহলে এই সম্মেলন সফল হবে এবং জনগণও আওয়ামী লীগের প্রশংসা করবে।
পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ আমলে আওয়ামী লীগের লড়াই ছিলো নিবর্তন আইনের বিরুদ্ধে, বিনা বিচারে আটক রাখার বিরুদ্ধে, রেডিও টেলভিশন ও সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে এবং আদালতে দলমত সকলের জন্য ইনসাফের দুয়ার খুলে রাখা। আজ ৮ বছর হলো আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসীন তখন বিরোধী দলগুলোকে ঠিক ঐসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উচ্চকণ্ঠে, সরব হতে হবে কেন? সম্মেলন অর্থ হলো সমাজের সর্ব শ্রেণী থেকে ডেলিগেট এবং কাউন্সিলরদের সমাবেশ। এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য আসবেন তৃণমূল থেকে। তৃণমূল নেতারা কিন্তু জনগণের নাড়ির স্পন্দন ভালোভাবে বোঝেন। একটি বদ্ধ সমাজ দেশ বিশেষের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা এবং দেশের কারাগারগুলো ধারণ ক্ষমতার বেশী রাজনৈতিক বন্দী দিয়ে ঠাঁসা থাকা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির লক্ষণ নয়। তাই দেশবাসীর প্রত্যাশা, যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অতীতে ছিলেন ভুক্তভোগী তাই সেইসব নেতা-কর্মী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের অতীত গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে আরেকবার সমুন্নত করবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন