বৈশ্বিক অর্থনীতি এ যাবৎ কাল পর্যন্ত ৩টি শিল্প বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে। শিল্প বিপ্লবের ফলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে ব্যাপক পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হয়। বর্তমানে বিশ্ব অবলোকন করছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যাকে অনেকে ৩য় শিল্প বিপ্লবের ২য় ধাপও বলে থাকেন। প্রতিটি শিল্প বিপ্লবে পূর্বেকার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি শিল্প বিপ্লব একটির সাথে অপরটি পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত।
শিল্প বিপ্লব নতুন বা আধুনিক কোন ধারণা নয়। এর সূচনা অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ১৭৬৩ সালে বিশ্ব প্রথমবারের মত শিল্প বিপ্লবের সাথে পরিচিত হয়। ১৭৬৩-১৭৭৫ সালে জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে শুরু হয় প্রথম বিপ্লব। এর ফলে প্রভূত অগ্রগতি অর্জিত হয়। বাষ্পীয় ইঞ্জিন মূলত যান্ত্রিক শক্তি দ্বারা মানুষের শারীরিক শক্তির প্রতিস্থাপন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসে প্রথম বিপ্লব প্রযুক্তিগত পূর্ণতা পায় এবং এর শেষভাগে শুরু হয় দ্বিতীয় বিপ্লব। ১৮৭০- ১৯১৪ এ সময়কাল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের এবং এর মূল আবিষ্কার ছিল বিদ্যুৎ। ক্রমেই বিদ্যুৎ চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলে বাষ্পীয় ইঞ্জিন প্রতিস্থাপিত হয়ে পড়ে। এ সময়ের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো, প্লাস্টিক, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের শুরু ১৯৬৯ সাল থেকে এবং একে ডিজিটাল বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ, এর মূল আবিষ্কার ছিল কম্পিউটার যা সকল ধারণাকে ডিজিটালি পরিণত করতে পারে। এ বিপ্লবের আরো একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায় ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোনের উদ্ভব যার সাথে এখন আমরা সকলেই পরিচিত। বর্তমানের স্মার্ট ফোনটিও ছোটখাটো একটি কম্পিউটারেরই নামান্তর। তৃতীয় বিপ্লবের ৫০ বছর পরই তৃতীয় বিপ্লবকে সাথে নিয়ে শুরু হয় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ২০১৬ সালে সর্ব প্রথম চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা সকলের সামনে উন্মোচিত হয়। এর মূূল ধারণা হচ্ছে- পূর্ববর্তী শিল্প বিপ্লবগুলো শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করেছে তবে চতুর্থ বিপ্লব শারীরিক এবং মানসিক উভয় পরিশ্রমকেই প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম।
প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বিপ্লবকেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলা হয়। এ বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও কল্যাণমুখী করা সম্ভব। এ বিপ্লব ই-প্রযুক্তিকে ভৌত, ডিজিটাল ও জৈব তিনটি ক্ষেত্রেই বিস্তৃত করেছে। এর মাধ্যমে অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। এ বিপ্লবে মেশিনকে বুদ্ধিমান করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে। আমরা অনেকেই ‹সাইবর্গ› নামটির সাথে পরিচিত যা দেখতে মানুষের মত এবং অন্যান্য আচার-আচরণও তাই এবং তা ন্যানে টেকনোলজির সাহায্যে নিজেই নিজেকে আপগ্রেড করতে পারে। আজ থেকে এক যুগ আগেও মানুষ যা ভাবতে পারতো না এই বিপ্লবের যুগে তাই হচ্ছে। চতুর্থ বিপ্লব ভার্চুয়াল জগতেরই আরও বিস্তৃত পরিসর। এক প্রতিবেদনে উঠে আসে বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একদিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি মেইল পাঠানো হয় এবং গুগলে মানুষ প্রতিদিন ৪২০ কোটি বার বিভিন্ন বিষয় সার্চ করে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সামগ্রিক প্রভাব আমাদের জীবনে খুবই বিস্তৃত এবং গভীর। এর উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবনগুলো হলো, রোবট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ড্রোন, ভিআর বা ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, অগমেন্টেড রিয়্যালিটি, থ্রিডি প্রিন্টিং, আইওটি, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং আরো অনেক ক্ষেত্র। রোবটের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। মানুষের জন্য দুর্গম স্থানগুলোতে রোবটের সাহায্য নিয়ে কাজ করা যায়। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির সাহায্যে আমরা স্কাই ডাইভিং, গুহার অভ্যন্তর, সমুদ্রের তলদেশসহ এমন আরো অনেক জায়গার আনন্দ উপভোগ করার মত আনন্দ পেতে পারি। চিকিৎসাক্ষেত্রে এর রয়েছে বিস্তৃত ব্যবহার। অনেক জটিল অপারেশন ছুড়ি-কাঁচি ছাড়াই কম্পিউটারের সাহায্যে করা সম্ভব হচ্ছে। ‘ফাস্ট অ্যাণ্ড ফিউরিয়াসসহ অনেক জনপ্রিয় মুভিতেই আমরা এ বিপ্লবের বহুমাত্রিক ব্যবহার দেখেছি। অন্যান্য উন্নত দেশের মত বাংলাদেশও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারে পৌঁছে গেছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে বুদ্ধিমান যন্ত্র কম্পিউটারকে ব্যবহার করা হচ্ছে শতভাগ। পকেটে রাখা এন্ড্রয়েড বা স্মার্ট মোবাইল ফোনটিও একটি কম্পিউটারই বটে। বাসা- বাড়ির সকল ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতিতে সেন্সর লাগিয়ে তা মোবাইলে ব্লুটুথের মাধ্যমে কানেক্টেড করে যেকোনো স্থান থেকে অপারেট করা সম্ভব। ঘরের তাপমাত্রা পরিমাপ করে তা কমানো বা বাড়ানোও যায় এর মাধ্যমে। আজকাল মানুষের আর শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না বললেই চলে। শারীরিক পরিশ্রম বিমুখতায় মানুষের শারীরিক বিভিন্ন সমস্যাও দেখা দিয়েছে প্রকট আকারে। হার্টের রোগী বেড়েছে কয়েকগুণ। শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটছে চরম পর্যায়ে। আত্মহত্যা প্রবণতাও বেড়েছে সমানুপাতিক হারে।
শুধু শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যই নয়, অনেক স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ বর্তমান বিপ্লবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারায় পিছিয়ে পড়ছে। কায়িক পেশার চেয়ে মেধাভিত্তিক পেশার প্রয়োজন বাড়ছে ক্রমাগত। প্রকট হচ্ছে বেকার সমস্যা। হিসাবরক্ষক, আর্থিক বিশ্লেষক, কর উপদেষ্টা, গ্রন্থাগারিক, টেলিফোন অপারেটর, নিরাপত্তাকর্মী, কোষাধ্যক্ষ, বিক্রয়কর্মী, ফিলিং স্টেশনের কর্মী, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার প্রভৃতি কর্মীর চাহিদা নেমে আসবে অনেক নিচে, ঠেকবে তলানিতে এসে। তাদের সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে রোবট। সমাজে তৈরি হবে চরম বৈষম্য ও অর্থনৈতিক বিভাজন। প্রোগ্রামার, আইওটি, আইটি, এআই এসকল বিষয়ের ওপর অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার থাকবে। এছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে এখন ড্রোন ব্যবহার করে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে যুদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে। এর মাধ্যমে যুদ্ধের পরিণতি আরও ভয়াবহরূপে প্রতীয়মান হতে পারে। এ নেতিবাচক দিকগুলোর মোকাবিলা করতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা, পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা।
বাংলাদেশও প্রস্তুত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলা করার জন্য। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত সকল খাতকেই গুরুত্ববহ করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের ই-গভর্নেন্স, সার্ভিস ডেলিভারি, পাবলিক পলিসি অ্যাণ্ড ইমপিমেন্টেশন, আইটি, বিকেন্দ্রীকরণ, নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা, এসডিজি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও প্রশাসনিক নীতি, ক্লাউড সার্ভার, আইওটি, এআই ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। চতুর্থ বিপ্লবে বাংলাদেশ সর্বাধিক গুরুতের সাথে নিয়েছে শিক্ষাখাতকে। এর জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল টেকনোলজি, ন্যানো টেকনোলজি, ই-কমার্স, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, নেটওয়ার্ক অ্যাণ্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, সাইবার নিরাপত্তা, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংশিষ্ট বিষয়ে শিক্ষাদানসহ গবেষণায় উৎকর্ষ সাধনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ দুটি সাবমেরিন কেবলের সাথে সংযুক্ত এবং তৃতীয় সংযোগের কাজ চলমান রয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্মের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য আইসিটি বিভাগ ‘লার্নিং এণ্ড আর্নিং’ নামক ৫০দিন ব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এছাড়াও ‘শি পাওয়ার’ বা ‘প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন’ নামক একটি প্রকল্প রয়েছে যার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হবেন নারীরা। সর্বোপরি, বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে নিজেদের করে নেওয়ার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে এবং সকলেই আশাবাদী এই শিল্প বিপ্লব দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাতছানিতে আগামী কয়েক বছরেই মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকই আমাদের প্রভাবিত করে। তবে এর অগ্রযাত্রাকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করার জন্য আমাদের অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কর্মসংস্থান, গোপনীয়তা রক্ষাসহ এসকল ক্ষেত্রগুলো থেকে নেতিবাচক প্রভাব গুলোকে রোধ করতে হবে। সর্বোপরি প্রযুক্তিকে সঠিক পন্থায় ব্যবহার করতে হবে তবেই আমরা কাঙ্খিত সুফল লাভ করতে সক্ষম হবো।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন