ভোগ্যপণ্য লবণ অপরিহার্য পণ্য। গ্রামগঞ্জের কৃষকরা শ্রম-ঘামে দেশকে ‘খাদ্যে’ স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকা বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় হওয়ায় লবণ উৎপাদনে সাফল্য দেখাচ্ছেন দেশের কৃষকরা। দেশের লবণ শিল্প বড় হয়েছে। কিন্তু ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা। লবণচাষিরা এক কেজি অপরিশোধিত লবণের যে দাম পান রাজধানী ঢাকায় সে লবণ বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪০ গুণ বেশি দরে। কৃষক পর্যায়ে পরিশোধিত করে লবণ বিক্রির কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে উৎপাদন করে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন হাজার হাজার লবণচাষি। শুধু তাই নয়, ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে লবণ আমদানির উদ্যোগ। মিলাররা বলছেন, মিলে লবণের মজুত কমে গেছে। তবে উৎপাদন শুরু হওয়ায় সে সংকট কেটে যাবে। তারপরও একটি সিন্ডিকেট সঙ্কটের অজুহাত তুলে অসময়ে মন্ত্রণালয়কে চাপ দেয়ায় ৩ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যেই ২২২টি প্রতিষ্ঠান লবণ আমদানির আবেদন করেছে। লবণ আমদানির সিদ্ধান্তে কৃষক পর্যায়ে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। কৃষকরা বলছেন, লবণ আমদানি করা হলে হাজার হাজার লবণচাষি উৎপাদিত লবণ বিক্রি করতে পারবেন না। লবণ চাষে নিরুৎসাহিত হবেন। যেমন পাট চাষে নিরুৎসাহি হয়েছেন কৃষকরা। এতে করে পাট শিল্পের মতো লবণ শিল্পে ধস নামবে। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে লবণ চাষিদের কিছু প্রণোদনা দেয়া হলে ‘খাদ্যের’ মতোই ‘লবণ শিল্পে’ দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব।
জানতে চাইলে বিসিক চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব মো: মোশতাক হাসান বলেন, লবণের চাহিদা আগামীতে দ্বিগুণ হতে পারে। যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দেশের স্বার্থে। সেই চাহিদা পূরণ করতে পারলে আমদানির পথ বন্ধ করা হবে। প্রয়োজনে কৃষির ন্যায় লবণ শিল্পতেও ভর্তুকি দেওয়া হবে।
কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, লবণ উৎপাদনের নতুন মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। শীতকালে লবণ চাষ শুরু হয়। বৃষ্টি শুরু হলে চাষ বন্ধ হয়ে যায়। এ বছর পর্যাপ্ত রোদ ও কম বৃষ্টিপাত থাকায় লবণ উৎপাদন ভালো হয়ে গেছে। লবণ চাষে সাগর পাড়ের কৃষকরা প্রচণ্ড ব্যস্ত। জোয়ারের পানি ধরে রাখতে তারা খণ্ড খণ্ডভাবে জমি প্রস্তুত করছেন। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে শুধু কক্সবাজার জেলার ৭০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন শুরু হবে। মৌসুমের শুরুতে লবণ চাষিরা যখন উৎপাদনের জন্য মাঠে নেমেছে, তখনই বিদেশ থেকে লবণ আমদানির খবরে তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। লবণের কোনো ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও আমদানির বিষয়টি আত্মঘাতী বলেই মনে করছেন তারা।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিন লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। লবণ আমদানির সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক ও কক্সবাজারস্থ বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জাফর ইকবাল ভূঁইয়া। সরকারের লবণ আমদানির এই সিদ্ধান্ত এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে।
জানতে চাইলে কক্সবাজারস্থ বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, চলতি মৌসুমে সরকার লবণের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা আরো এক লাখ বাড়িয়ে ২৩ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করেছে। গেল বছর এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২২ লাখ মেট্রিক টন। গত মৌসুমে উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ১৬ মেট্রিক টন। গত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে লবণের মজুদ রয়েছে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন ব্যাহত হবার আশঙ্কায় ৩ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত সরকার নিয়ে রেখেছে। জানুয়ারিতে সে লবণ আসবে।
লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েই গত সোমবার কক্সবাজারে বসে লবণ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবিনিময় সভা। জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে দেশের অন্যতম লবণ উৎপাদন এলাকার লবণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় সভাটি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেনÑ শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মোসতাক হাসান।
সভায় চলতি লবণ মৌসুমের সমস্যা ও উৎপাদনের বিষয়ে আলোচনা করা হয় বলে সভা সূত্রে জানা গেছে। তবে গেল লবণ মৌসুমের শুরুতে এ রকম আলোচনা বা মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়নি। যখন লবণের মাঠ পর্যায়ে দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে যাবার পর চাষিরা হতাশ হয়ে মাঠ ছেড়ে পালানো শুরু করেছিল, তখনই প্রায় শেষদিকে এসে সরকারি পর্যায়ে মাঠের চাষিদের সান্ত¦না দেওয়া শুরু হয়েছিল।
সেদিক দিয়ে এবার মৌসুমের শুরুতে লবণের স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে মতবিনিময় সভাটি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে লবণ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এতে করে মাঠের চাষিদের মনে একটা উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পড়তে পারে। সরকারি এমন উদ্যোগ মৌসুমের শুরুতে হওয়ার কারণে লবণ চাষিদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তদুপরি খোদ শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং লবণ শিল্পের তদারকি সংস্থা বিসিকের চেয়ারম্যানের মতবিনিময়ে উঠে আসা সমস্যাদি সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে লবণ সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়াদির সহজ সমাধানেও সহায়ক হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির একজন শীর্ষ নেতা ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে দেশে লবণের ঘাটতি আছে এটা সঠিক। কিন্তু কিছুদিন পরই উৎপাদন শুরু হচ্ছে। এ সময়ে আমদানির সিদ্ধান্ত লবণ চাষিদের জন্য একটি দুঃসবাদ। চাষিরা এই সময়ের জন্য বছরব্যাপি অপেক্ষায় থাকেন। এখন আমদানি করা হলে চাষিরা তাদের হক থেকে বঞ্চিত হবেন। ভবিষ্যতে লবণ চাষে নিরুৎসাহিত হবেন। যা দেশের জন্য বড় ক্ষতি। মূলত একটি স্বার্থান্বেষী গ্রুপ শিল্প মন্ত্রণলায়কে ম্যানেজ করে সুপারিশ পাঠিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়ে লবণ আমদানির অনুমোদন করাচ্ছে। আমিও একজন ব্যবসায়ী আমিও চাইব লবণ আমদানি হোক। একই সঙ্গে এই সময়ে লবণ আমদানি হলে আমি ব্যসায়ীদের সঙ্গে থাকছি না। ঘাটতি থাকলেও তা আরও কয়েক মাস আগে আমদানি করা প্রয়োজন ছিল। এখন আমদানির সিদ্ধান্ত লবণ চাষিদের পথে বসিয়ে দিবে।
লবণ চাষিদের একটি মাত্র আতঙ্ক সেটি হচ্ছে ‘আমদানি’। লবণ আমদানির খবর শুনলেই চাষিরা হতাশ হয়ে পড়েন। তাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আমদানি শব্দটিই যেন লবণ চাষিদের কাছে পাহাড়-পর্বত সমান বালা-মুসিবত। মৌসুমের শুরুতে আমদানির সিদ্ধান্তের কথা শুনলেই চাষিরা আর মাঠে নামতে চায় না। তার কারণ হচ্ছে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হলে দেশিয় উৎপাদিত লবণের দাম পড়ে যায়। তখন চাষিরা তাদের উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে ন্যায্য মূল্য পায় না। চাষিরা বলছেন, দেশের লবণচাষিদের বাঁচাতে আমদানি পরিহার করাটাই শ্রেয়। চাষিরা মনে করেন, মৌসুমের শুরুতেই লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়ার মানেই হচ্ছেÑ ‘গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মত ঘটনা’। আমদানির পরিবর্তে করোনা-পরবর্তী সময়ে চাষিদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে মাঠ পর্যায়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলে দেশ লবণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কবির বলেন, লবণ নিয়ে যে আইন করা হয়েছে তাতে অনেক জটিলতা আছে। আইন মানতে গিয়ে ছোট মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই আইনের বিধিবিধান বাস্তবায়নে শিথিল করা প্রয়োজন।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, সোডিয়াম সালফেড বিতর্কে গত বছর মাঠে নামেনি চাষিরা। লবণের চাহিদা ও ঘাটতি নিয়ে কমিটির গঠনের মাধ্যমে জরিপ করতে হবে। আমদানি করার সিদ্ধান্ত ৬ মাস আগে থেকে চাষিদের জানানো প্রয়োজন। মহেশখালী উপজেলা চেয়ারম্যান শরীফ বাদশা বলেন, মহেশখালীতে প্রচুর জমি রয়েছে। লবণ উৎপাদনে কোনো ঘাটতি হবে না। ঘাটতি হলে সব লবণ তিনি দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। মহেশখালী পৌরসভার মেয়র মকছুদ মিয়া বলেন, ৩ বছর আগে ৪০০ একর জমিতে লবণ চাষ করেছি। কিন্তু গতবার শুধু ৫০ একর জমিতে লবণ চাষ করতে পেরেছি। তাতেও ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। মিল মালিকরা এক মণ লবণে ওজন হিসেবে ৪৫ থেকে ৪৮ কেজি ধরে। তবুও ন্যায্য মূল্য দেয় না।
এমপি আশেক উল্লাহ রফিক এমপি বলেন, লবণের বিষয়টি আমাদের এলাকার জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। চাষিরা দাম না পেলে যেমনি সরকারের ওপর নাখোশ হন, তেমনি আবার বাজারে কোনো কারণে সঙ্কট সৃষ্টি হলেও দোষ পড়ে সরকারের ঘাড়ে। তাই সরকার এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন