চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা এবং প্রাণহানী বেড়েই চলেছে। ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও সহিংস ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণ হারিয়েছেন ৯ জন।
অথচ চলমান ইউপি নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে কোনও সহিংসতা হয়নি বলে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। তিনি এ নির্বাচনকে একটি সহিংসতাহীন নির্বাচনের মডেল বলে অখ্যায়িত করেছেন। ২৮ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন স্থানে তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন ভবনে সাংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি করেন।
তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) গতকাল এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, সারাদেশে বিভিন্ন ধাপে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে যেভাবে সহিংসতা হচ্ছে তা সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। ইউপি নির্বাচনে চর দখলের মতো কেন্দ্র দখলের মহড়া হচ্ছে। হামলা-পাল্টা হামলা আর খুনোখুনিতে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে গ্রামাঞ্চলে।
এদিকে আমাদের সংবাদাতাদের পাঠানো তথ্যানুযায়ী, তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় বিজিবি সদস্যসহ প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৯ জন। এর মধ্যে ভোটের আগের রাতে আধিপত্য বিস্তার ও কেন্দ্র দখলের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২ জন। ভোটের দিন বিকালে ও সন্ধ্যা রাতে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের সময় সংঘর্ষ ও গুলিতে প্রাণ গেছে আরও সাতজনের। এর মধ্যে নরসিংদীর রায়পুরায় ২ জন, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে ৩ জন, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে বিজিবি সদস্য, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে ১ জন রয়েছেন। এছাড়া ভোটের আগের রাতে সহিংসতায় খুলনার তেরখাদায় ১ জন ও যশোরের শার্শায় ১ জন মারা যান।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার খনগাঁও ইউনিয়নের ঘিডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটগণনার সময় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ৩ জন নিহত ও অন্তত ৪ জন আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। নিহতরা হলেন- ঘিডোবপুর গ্রামের সাহাবলি আহম্মেদ (৩৫), মোজাহারুল ইসলাম (৪০) ও অবিনাশ চন্দ্রের ছেলে আদিত্য (২০)। ঘটনাস্থলেই ২ জন ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
নরসিংদীর রায়পুরায় পুলিশের গাড়িতে হামলা করে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ২ জন নিহত হয়েছেন। এসময় ৩ পুলিশ সদস্যসহ আরও ২২ জন আহত হয়েছেন। ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দি ও উত্তর বাঘারনগর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম আরিফ (৩২) ও উত্তর বাখরনগরে ফরিদ মিয়া (৩২)। আরিফ শিবপুর যোশর জাঙ্গারটেক গ্রামের মৃত চান মিয়ার ছেলে। পেশায় তিনি সিএনজিচালক।
নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের একটি ভোটকেন্দ্রে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মো. রুবেল (৩৫) নামে বিজিবির এক সদস্য নিহত হয়েছেন। ২৮ নভেম্বর রাতে ভোট গণনাকালে এ ঘটনা ঘটে।
লক্ষ্মীপুরে রামগঞ্জ উপজেলার ইছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সজিব হোসেন নিহত হয়েছেন। গতকাল নির্বাচন চলাকালীন বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ওই ইউনিয়নের নয়নপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রের সামনে এ ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহেনাজ আক্তার ও বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী আমির হোসেন খানের সমর্থকদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ছাত্রলীগ নেতা সজিব হোসেন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহেনাজ আক্তারের সমর্থক ছিলেন।
নির্বাচনী সহিংসতায় খুলনার তেরখাদা উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নে বাবুল শিকদার (৩৮) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. মহসিনের সমর্থক ছিলেন। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, নির্বাচনী বিরোধকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের আগেরদিন দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে তেরখাদা উপজেলাধীন মধুপুর ইউনিয়নের কুলাপাটগাতি গ্রামের বাবুল শিকদারকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী কামাল হোসেনের লোকজন হাতুড়িসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায়। পরে এলাকাবাসী মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত বাবুল শিকদারকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে পাঠান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৮ নভেম্বর ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে বাবুল শিকদার মৃত্যুবরণ করেন।
ইউপি নির্বাচনে পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে যশোরের শার্শায় দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আনারস প্রতীকের সমর্থক কুতুব উদ্দীন (৩৫) নিহত হয়েছেন। নির্বাচনের আগেরদিন রাত ৯টার দিকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় তিন স্থানে হামলা ভাঙচুর লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। গত রোববার রাতে বারদী, জামপুর ও পিরোজপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে এ সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সোনারগাঁ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোস্তফা মুন্নাসহ প্রায় ৩৫জন আহত হয়েছে। আহতদের সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তিসহ প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বারদী এলাকায় বর্তমান চেয়ারম্যান জহিরুল হকের বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ সময় সাংবাদিকদের বহনকারী একটি গাড়িসহ প্রায় ৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে হামলাকারীরা। এ ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় পৃথক তিনটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন