ব্যাপক সংঘাত ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে নিহত হয়েছে ৭ জন, আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক। মূলত একদলীয় এ নির্বাচনে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত এবং বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে। এ সংঘাত-সংঘর্ষে নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। নির্বাচনী সহিংসতার দায় যেমন অনিবার্যভাবে নির্বাচন কমিশনের, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের ওপরও বর্তায়। এই দুই পক্ষই নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিরোধীদলবিহীন এ নির্বাচনে আদতে কোনো ধরনের সহিংসতা হওয়ার কথা নয়। নিজেদের মধ্যকার নির্বাচনে এমন সহিংস হওয়ার নজির বিরল। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও এ নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত উস্মা প্রকাশ করেছেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদের যে নির্বাচন হয়েছে, এটাকে কোনো নির্বাচন বলা যায় না। এটা অরাজকতা। জোর করে ভোট দেয়ার কাজকে নির্বাচন কমিশন বৈধতা দিচ্ছে। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, বেতনভাতা নিলেও নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করছে না। তাদের এ কথা থেকেই বোঝা যায়, ইতোপূর্বে ইউপি’র যেসব নির্বাচন হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। নির্বাচনের নামে ফ্রি স্টাইলে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে বা অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে বিশ্লেষকরা বরাবরই বলে আসছেন। একতরফা নির্বাচনের অপসংস্কৃতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া নির্বাচন এবং দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ায় নির্বাচন তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ হবে, তাতে কোনো ধরনের সহিংসতা হবে না, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। অথচ ঘটেছে উল্টোটা। নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূল কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় একপাক্ষিক নির্বাচনে পদ-পদবী পেলে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা থাকে। রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হওয়া যায়। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা এ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসতে চাওয়ার কারণে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। অথচ দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে, বিরোধীদল না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা নিরঙ্কুশ আধিপত্যে তারই নির্বাচিত হওয়ার কথা। তা না হয়ে নিজ দলের লোকজনই বিদ্রোহী হয়ে প্রার্থী হয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সৃষ্টি করেছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীন দল একতরফা নির্বাচনটিও শান্তিপূর্ণভাবে করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের যেমন নিবৃত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালন করতে শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতায় ৯২ জন নিহত এবং ৬ হাজার ৪৮ জন আহত হয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনার দায় কে নেবে? নির্বাচন কমিশন, এমনকি ক্ষমতাসীন দল কি এর দায় নিয়েছে বা এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও আর যাতে না ঘটে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে? নেয়নি। নেয়নি বলেই নির্বাচনে এখন মানুষের প্রাণহানি ও আহত হওয়া এবং সম্পদ বিনষ্ট হওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বলতে কিছু নেই। তারা মনে করে, নির্বাচন মানেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর নিশ্চিত বিজয়। তারপরও নির্বাচনী সংঘাতের খেসারত তাদের দিতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচনকে দুর্বৃত্তদের অভয় ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। নির্বাচনে কোনো রাজনীতি নেই। এটা দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্ষমতাশালী হওয়ার উন্মুক্ত ক্ষেত্রে পর্যবসিত হয়েছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা এতটাই যে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জনগণের অর্থে বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। এসব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে তো ব্যর্থ হচ্ছেই, এমনকি জনগণের জানমালের নিরাপত্তাটুকু পর্যন্ত তারা দিতে পারছে না। বরং নির্বাচন শেষে ‘নির্বাচন সুষ্ঠু’ হয়েছে বলে নির্লজ্জ বিবৃতি দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন, এ নির্বাচন কমিশন থাকতে সামনে আরও যেসব নির্বাচন হবে, তাতেও সংঘাত এবং মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে। নির্বাচন কমিশন যদি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রয়োগে যথাযথ পদক্ষেপ নিতো, তাহলে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে পারত। আমরা মনে করি, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব সংঘাত-সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে, তা নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই। আগামী জাতীয় নির্বাচনের খুব বেশি দেরি নেই। একতরফা ও সংঘাতপূর্ণ নির্বাচনের এই ধারাবাহিকতা যদি চলতে থাকে, তাহলে সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এখন থেকেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সঠিক ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তারা যাতে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলো দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন