সুনামগঞ্জের ছাতকে নোয়াখালী থেকে বহিরাগত ৪ শিক্ষার্থীর আসল পরিচয় গোপন রেখে নকল পরিচয়ে নাগরিক ও জন্ম সনদ তৈরির অভিযোগ উঠেছে। এখানের বাসিন্দা হয়ে মেক্সিকাতে পাড়ি জমাতে পাসপোর্ট তৈরির জন্য আবেদন করে। ওই আবেদনের সূত্র ধরে তদন্ত নেমে পুলিশ এ জাল-জালিয়াতির প্রমাণ পায়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন আইনী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তবে পুলিশের বিশেষ শাখা ওই শিক্ষার্থীর পাসপোর্টের আবেদন বাতিল করেছেন।
জানা যায়, কয়েক বছর ধরে ছাতক উপজেলার কালারুকা ইউনিয়নের বলারপীরপুর গ্রামের বাসিন্দা ফারুক মিয়া ওরফে কামাল মিয়া লাতিন আমেরিকার দেশ মেক্সিকাতে বসবাস করছেন। তিনি সম্প্রতি ওই দেশের নাগরিক সনদ পেয়েছেন। তার স্ত্রী তাছলিমা বেগম তাদের মেয়ে তানজিদা আক্তার তাইবা (জন্ম তাং-১৭.১০.২০১১ইং), তাওহিদা আক্তার তানহা (জন্ম তাং-২১.০২.২০১৩ইং) ও ছেলে তাসকিন মিয়া (জন্ম তাং-২৩.০৪.২০১৫ইং) নামের রয়েছে ৩ সন্তান। মেক্সিকো প্রবাসী ফারুক মিয়ার স্ত্রী তাছলিমা বেগম তার ৩ সন্তানসহ তাদের ছেলে হিসেবে শওকত মিয়া (জন্ম তাং-০১.০৩.২০০৬ইং), শাকিল মিয়া (জন্ম তাং- ২৬.০৬.২০০৭ইং), শাহেদ মিয়া (জন্ম তাং-২৩.০২.২০০৯ইং) ও তাওহিদ মিয়া (জন্ম তাং-২৯.০৫.২০১০ইং) সকলের জন্য গত ৬ অক্টোবর আটজনের পাসপোর্ট তৈরীর জন্য সুনামগঞ্জে পাসপোর্ট কার্যালয়ে আবেদন করেন। ওই আবেদনগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পুলিশের বিশেষ শাখা তদন্তে নামে। আর পুলিশ তদন্ত করতে গিয়েই ধরা পড়ে এই জালিয়াতির চিত্র। শওকত মিয়া, শাকিল মিয়া, শাহেদ মিয়া ও তাওহিদ মিয়া থানায় হাজির হলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আসল নাম-ঠিকানা পরিচয় বেরিয়ে আসে। ওই ৪ ছাত্র ছাতকের প্রবাসী ফারুক মিয়ার ছেলে পরিচয়ে মেক্সিকোতে পাড়ি জমাতেই এই প্রতারনার আশ্রয় নেয়।
এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৪ জনকেই ছাতক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবু সাদাত মো. লাহিন কাগজে জিম্মানামায় স্বাক্ষর করে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এ ঘটনায় ছাতক থানায় গত ২৮ অক্টোবর একটি সাধারণ ডায়রী (নং-১৪৮১) করা হলেও রহস্যজনক কারণে অভিযুক্ত কারো বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেক্সিকো প্রবাসী ফারুক মিয়ার নিজের ছেলে হিসেবে শওকত মিয়া, শাকিল মিয়া, শাহেদ মিয়া ও তাওহিদ মিয়ার নামে ছাতক উপজেলার কালারুকা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যে নাগরিক সনদ ও জন্ম নিবন্ধন করেছেন, ওই ছেলে ফারুক মিয়ার সন্তান নয়। কৌশলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের ছেলে পরিচয়ে নাগরিক সনদ ও জন্ম নিবন্ধন তৈরী করা হয়েছে। শওকত মিয়ার আসল নাম তানভির হোসেন। সে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানার বাংলাবাজার গ্রামের মহিন উদ্দিনের ছেলে। তানভির রাজধানী ঢাকা আইকন স্কুল অ্যান্ড কলেজ (হাজারীবাগ) শাখার মানবিক বিভাগের এসএসসি পরীক্ষার্থী (সদ্য সমাপ্ত) এবং ধানমন্ডি এলাকার রায়ের বাজার ১৫৬ নং বাসার বাসিন্দা। শাকিল মিয়ার আসল নাম তানজিল হোসেন। সে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার মীরওয়ারিশপুর গ্রামের দুলাল হোসেনের ছেলে। তানজিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র। তার বসবাস ঢাকার চকবাজার (চুড়িহাট্টা) এলাকার ৩৯/১ নং বাসায়। শাহেদ মিয়ার আসল নাম মো. ফাহাদ। সে সোনাইমুড়ি থানার বানিপুর গ্রামের দেলোয়ার হেসেনের ছেলে। ফাহাদ স্থানীয় পিতাম্বরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। তাওহিদ মিয়ার আসল নাম মো. শাওন। সে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানার নাওতলা গ্রামের দুলাল মিয়ার ছেলে। শাওন স্থানীয় সোনাইমুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। প্রবাসী ফারুক মিয়ার স্ত্রী তাছলিমা বেগম প্রথমে তার ৫ ছেলে ২ মেয়ে বললেও পরে তিনি স্বীকার করে বলেন, আমার এক ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে লেখাপড়ার সুবিধার্থে প্রায় ৩ বছর ধরে উপজেলার জাউয়াবাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। আমার স্বামী কন্ট্রাকে মেক্সিকো গিয়ে ওই দেশের নাগরিক হয়েছেন। আমার এক আত্নীয় পাসপোর্টের প্রসেসিং করছেন। আমার স্বামী দীর্ঘদিন ঢাকায় ছিলেন, তাই ওই ছেলেদের পরিবারের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়। ওরা আমার স্বামী ও আমাকে বাব-মা বলে ডাকে। ছোটবেলা থেকেই ওদের আমরা খেয়াল-নজর রাখছি। তিনি বলেন, এখন যদি আমরার লাগি বাইচ্চাদের লাইফ গড়ে, তাহলে আসুবিধা কোথায়।
ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য লিটন মিয়া বলেন, নাগরিক সনদ প্রদানে অনেক সময়েই চেয়ারম্যান সাহেব অগ্রিম সিল ও স্বাক্ষর করে রাখেন। ইউপি কার্যালয় থেকে যে ৪ জন ছাত্রকে নাগরিক সনদ ও জন্ম নিবন্ধন দেয়া হয়েছে এবিষয়ে তার কিছু জানা নেই। ইউনিয়ন পরিষদের সচিব পিংকু দাস বলেন, আমাদের কাছে প্রবাসী ফারুক মিয়া ও তার পরিবারের (শওকত মিয়া, শাকিল মিয়া, শাহেদ মিয়া ও তাওহিদ মিয়া) সহ সকলের সনদ সঠিক আছে। এ বিষয়ে কালারুকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অদুদ আলম বহিরাগত ৪ ছাত্রের নাগরিক সনদ ও জন্ম নিবন্ধনের বিষয়ে বলেন, এগুলোর ডকুমেন্ট দিয়েই সনদপত্র দেয়া হয়েছে আর জন্ম নিবন্ধন তো অনলাইনে আছে। নাগরিক সনদ গ্রহনকারীরা কোন জায়গার বাসিন্দা এটি তার দেখার বিষয় না। এতে তার কোন দায়ভারও নেই। জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনাটি তার নলেজে নেই, তবে খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন