তরুণদের কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। বিশ্বের ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। আর রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নাগরিক কর্মকা-সহ সব বিষয় যুক্ত করলে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম। বৈশ্বিক ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ইনডেকস-এ (ওয়াইডিআই) এই তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্ব মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকের আদলে এই সূচকটি তৈরি করেছে কমনওয়েলথ। এই প্রথম যুবকদের ওপর এ ধরনের একটি সূচক তৈরি করা হলো। সূচকে সেরা দেশ জার্মানি আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে এ মুহূর্তে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা ১৮০ কোটি; প্রতি চারজনে একজন তরুণ। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এই সংখ্যা বেশি। কিন্তু অনেক দেশই তরুণদের কাজে লাগাতে পারছে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল কার্যক্রম, প্রতিবাদ ও স্বেচ্ছা কার্যক্রমে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়লেও রাজনীতিতে তাদের আগ্রহ কমছে। এ ব্যাপারে তাদের হতাশা বাড়ছে। জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন অপরাধের শিকারও তরুণরা। আবার শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও তাদের ভূমিকা অনেক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নত, কী উন্নয়নশীল সব দেশেই কর্মসংস্থান একটি বড় সমস্যা। বলাই বাহুল্য, এই সমস্যার সবচেয়ে বড় শিকার তরুণরা। বাংলাদেশের তরুণদের অবস্থা যে অধিক শোচনীয়, সেটা বোঝার জন্য ব্যাপক কোনো গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। বাস্তবতা দৃষ্টেই তা উপলব্ধি করা যায়। ইউরোপ-আমেরিকার কথা বাদ; দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশের অবস্থান বাংলাদেশের ওপরে।
বাংলাদেশে তরুণদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় প্লাস পয়েন্ট। শক্তি, উদ্যম, উৎপাদনশীলতা, সৃজনশীলতা সব দিক দিয়েই তরুণরা এগিয়ে। বাংলাদেশের তরুণদের বিপুল সংখ্যায় একটা বিরাট আশীর্বাদ। তবু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বেশিরভাগ তরুণকেই আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। তারুণ্যের অপচয় হচ্ছে কিংবা তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেশে বেকারের সংখ্যা কয়েক কোটি যার বেশিরভাগই তরুণ। প্রতি বছরে শ্রমবাজারে আসছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ, যারা সবাই তরুণ। এখানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। আমরা তরুণদের সক্ষমতা ও সৃজনশীলতা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছি না। আমরা যদি আমাদের তরুণদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োজিত করতে পারতাম তাহলে অর্থনেতিক অগ্রগতি যেমন দ্রুতায়িত হতো তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রেও তার শুভ প্রভাব প্রতিফলিত হতো। বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনুকরণীয় সাফল্য অর্জন করেছে যার প্রশংসা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা করেছে। ক’দিন আগে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টও এই সাফল্যের প্রশংসা করে গেছেন। তিনি মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, সেনিটেশন সুবিধা সম্প্রসারণ, শিশু শিক্ষার বিস্তার, নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ইত্যাদির তারিফ করেছেন। তিনি তার সুপারিশের মধ্যে ভালো চাকরির ব্যবস্থা করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আসলে ভালো চাকরি বা সবার জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বৃদ্ধি অপরিহার্য। বাস্তবতা এই যে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তেমন একটা বাড়ছে না, যা বাড়ছে তাতে বছরে সাত-আট লাখের মতো লোকের বেকারত্ব ঘুচছে।
তরুণদের যথাযথভাবে ব্যবহার করা ছাড়া কোনো দেশেরই উন্নয়ন ও অগ্রগতির আকাক্সক্ষা পূরণ হতে পারে না। বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অথচ তার কোটি কোটি তরুণ কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার জীবনযাপন করছে। এদের সক্ষমতা, শ্রম, উদ্যোগ ও সৃজনশীলতার সংযোজন ছাড়া কিভাবে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে? কর্মক্ষম প্রতি জোড়া হাতকে কাজে লাগাতে হলে কর্মক্ষেত্র ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগ হলে শিল্পকারখানা হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, উৎপাদন-রফতানি বাড়বে এবং এর সুবাদে কর্মসংস্থানও বাড়বে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দীর্ঘদিন ধরে দেশী-বিদেশী কোনো বিনিয়োগই তেমন হচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ যেহেতু অতিরিক্ত শ্রমশক্তির দেশ, সে কারণে শ্রমশক্তি রফতানিরও বিরাট সুযোগ তার রয়েছে। এ সুযোগ নেয়া গেলে বেকারের সংখ্যাই কেবল হ্রাস পাবে না, সেই সঙ্গে প্রতিটি প্রবাসী কর্মী বা শ্রমিকের পরিবারের আর্থিক ক্ষমতায়ন ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটা নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ খাত থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাওয়ার কথা তা পাওয়া যাচ্ছে না। এর একটা বড় কারণ, জনশক্তি রফতানি বাড়ছে না। অনেকে আবার ফিরে আসছে। দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ এবং সকল সম্ভাবনা ও সুযোগ কাজে লাগাতে মানবসম্পদ উন্নয়নে আরো চেষ্টা ও বিনিয়োগ নিয়োজিত করতে হবে। কে না জানে, কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার তরুণরা পরিবার ও সমাজের বোঝায় পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়াও অসম্ভব নয়। হতাশ তরুণরা অনেক কিছুই করতে পারে, হয়ে উঠতে পারে অপরাধপ্রবণ এমনকি পেশাদার অপরাধীও। আমাদের দেশের সর্বপ্রকার অপরাধের সঙ্গে একশ্রেণীর তরুণের সংশ্লিষ্টতার কথা কারো অজানা নেই। যারা দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তারাই অনেকে ‘অভিশাপে’ পরিণত হয়েছে। এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তরুণদের কর্মসংস্থানে সর্বাত্মক অগ্রাধিকার দিয়ে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন