শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

নৌ-ডাকাতদের দৌরাত্ম্যে সাগরে অতিষ্ঠ জেলেরা

সাখাওয়াত হোসেন : | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

সাগরে সক্রিয় নৌ-ডাকাতদের একাধিক গ্রুপ। র‌্যাবের একের পর এক অভিযান এবং আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবন অনেকটাই দস্যু মুক্ত হলেও সাগরে এসব নৌ-ডাকাতের কাছে রয়েছে স্পিডবোটের মতো অত্যাধুনিক নৌযানও। এ ডাকাতদের অত্যাচারে জেলেদের জীবন এখন ভয়াবহ হুমকির মধ্যে।
উপকূলে প্রায় পাঁচ লাখ জেলের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের বেপরোয়া কর্মকা-ে। এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভোগান্তি তাদের নিত্যসঙ্গী। তার ওপর ডাকাতদের দৌরাত্ম্যে তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তবে সম্প্রতি র‌্যাবের অভিযানে অস্ত্র, নৌকা ও ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত মালামালসহ কয়েকটি গ্রুপের বেশ কিছু ডাকাতকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নৌ-ডাকাতদের গ্রেফতারে কাজ করছে র‌্যাব, কোস্টগার্ড ও বনবিভাগ।
র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, র‌্যাবের অভিযানে নৌ-ডাকাত দলের সদস্যরা ধরা পড়লেও পালিয়ে থাকা সদস্যদেরও গ্রেফতারে অভিযান চলমান রয়েছে। জেলেদেরা অভিযোগ, পুলিশকে জানালে কোনো কাজ হয় না। বরং এজন্য আরও ডাকাতদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তাই তারা অনেক সময় আপোষ করে চলতে হয়। এখনও চাঁদা পরিশোধ না করলে অনেক সময় হত্যার শিকার হতে হয় সাধারণ জেলেদের।
হাকিম হাওলাদার নামে দুবলার চরের এক জেলে গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সাগরে নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো টহল নেই। মাছ ধরার আড়ালে অনেক নৌকা ব্যবহৃত হচ্ছে ডাকাতি, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে। এসব নৌ-ডাকাতদের বিভিন্ন মাছ ধরার ঘাটেও রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। বিভিন্ন ঘাটের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে দস্যুদের লুটের শিকার হয়েছে শতাধিক নৌকা-ট্রলার।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী আমরা জানতে পারি, সুন্দরবনে আমাদের আভিযানিক সক্ষমতা অনেক বেড়েছে এবং আমরা সুন্দরবনে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তাই তারা সুন্দরবনের ভেতরে ডাকাতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিলো না বলে সমুদ্রে এখন ডাকাতি কার্যকম শুরু করছে। বলেশ্বর নদী থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে সমুদ্র এলাকায় নৌ-ডাকাতরা মূলত নিয়মিত ডাকাতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তিনি আরো বলেন, দস্যুদের অধিকাংশ সদস্যকে ইতিমধ্যে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি সদস্যদের গ্রেফতারে আমাদের অভিযান চলমান থাকবে।
একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে পাথরঘাটা, বরগুনা ও পটুয়াখালী সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে দূরবর্তী বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি দস্যুতার ঘটনা ঘটে। যেখানে দস্যুরা মাছ ধরার ট্রলারে হামলা করে জেলেদের অপহরণ, লুন্ঠণ ও মুক্তিপণ দাবি করেছে। এছাড়া সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় গুলিতে একজনের নিহতের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গত নভেম্বরের মাঝামাঝিতে পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনা হতে জেলেরা বোট নিয়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে গভীর সমুদ্রে যায়। এরপর ২০ নভেম্বর সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে (পাথরঘাটা, বরগুনা ও পটুয়াখালীর বলেশ্বর এবং পায়রা মোহনা) পর্যায়ক্রমে ৭টি নৌকায় ডাকাতি করে মোবাইলসহ মূল মাঝি ও কয়েকজন সদস্যসহ ৭ জনকে অপহরণ করে নৌ-ডাকাতরা। এরপর লুণ্ঠিত মালামাল বিক্রিসহ জিম্মি থাকা ৭ জনের পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মুক্তিপণ দিতে চাপ প্রয়োগ করে নৌ-ডাকাতরা।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, এ ঘটনাগুলোর গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক র‌্যাব চতুর্মুখী উদ্যোগ নেয় এবং আভিযানিক ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। র‌্যাব বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে ও সমুদ্রের নিকটবর্তী চরাঞ্চল যেমন: ডালচর, সোনারচর, চর মন্তাজসহ বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করে। পাশাপাশি হেলিকপ্টারযোগে টহল পরিচালনা করে র‌্যাব।
তিনি আরো বলেন, র‌্যাবের গতিবিধি ও তৎপরতা আঁচ করতে পেরে সর্বশেষ অপহৃতদের গত ২৩ নভেম্বর নৌকায় রেখে ডাকাতরা চলে যায়। তবে যাওয়ার সময় স্থানীয় জেলে নৌকাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিয়ে এসে ভিকটিমদের ওপরে হামলা চালিয়ে কৌশলে স্থান ত্যাগ করে। অপহৃতদের ছেড়ে দেয়ার পরেও র‌্যাব নৌ-ডাকাতদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখে মোবাইল ব্যাংকিং ট্রান্সফারের মাধ্যমে মুক্তিপণের অর্থ প্রবাহের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে। র‌্যাব গোয়েন্দারা নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে এ সংক্রান্ত ফুটপ্রিন্ট শনাক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩০ নভেম্বর নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকা হতে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমায় জেলেদের নৌকায় ডাকাতির মূল মুক্তিপণ সংগ্রাহক মো. ইলিয়াস হাসেন মৃধাকে পাঁচ লাখের অধিক টাকাসহ গ্রেফতার করে। যার ধারবাহিকতায় আগ্নেয়াস্ত্রসহ জলদস্যুদলের মূল সমন্বয়কারী মো. খলিল জমাদ্দারসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খলিল তালতলী, আমতলী, পটুয়াখালীতে দোকান পরিচালনার ছদ্মবেশে ডাকাতি কার্যক্রমের সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে থাকে।
জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর ও আশপাশের এলাকায় মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত রয়েছে অন্তত ৫০ হাজার ট্রলার। বৃষ্টিবাদল আর ঝড়তুফান উপেক্ষা করে নদীতে মাছ ধরতে যায় জেলেরা। কিন্তু নৌ-ডাকাতদের কবলে পড়ার আশঙ্কা থাকে প্রতি মুহূর্তেই। চাঁদার দাবিতে মাছ ধরার ট্রলার, জেলে ও মাঝিদের অপহরণ করা হচ্ছে। মুক্তিপণ না দিলে হত্যা করে নদীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে যায় তারা। দেশে নদী ও সাগরে ইলিশ ধরার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত জেলেদের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। আর পরোক্ষভাবে আরও জড়িত প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। নদী ও সাগরের এই সব জেলেদের যথাযথ নিরাপত্তা না দেয়া গেলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। ঘাটতি হবে আমিষের। এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন