বেগম জিয়ার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। কারণ এই মুহূর্তে (যখন লিখছি তখন শনিবার ৪ ডিসেম্বর) যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন যে ম্যাডাম কেমন আছেন? তাহলে দুই রকম উত্তর পাবেন। বেলা ১১টা ৫৫ মি. ‘প্রথম আলোর’ সংবাদ শিরোনাম, ‘খালেদা জিয়ার রক্তক্ষরণ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি’। খবরে বলা হয়েছে, ‘সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বড় ধরনের রক্তক্ষরণ হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের একজন গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, থেমে থেমে রক্তক্ষরণ তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পর্যন্ত তার চার বার রক্তক্ষরণ হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন, বিদেশ না পাঠিয়ে বেগম জিয়াকে তিলে তিলে হত্যা করা হচ্ছে।’ একই দিন, অর্থাৎ ৪ ডিসেম্বর শনিবার ইংরেজি ‘দৈনিক নিউ এজের’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম, Khaleda takes solid food, but her condition unchanged. অর্থাৎ খালেদা সলিড ফুড খাচ্ছেন, কিন্তু তার অবস্থা অপরিবর্তিত। খবরে বলা হয়, ‘একজন চিকিৎসক এবং তার পরিবারের একজন সদস্য বলেছেন যে, তিনি বাসায় রান্না করা খাবার এবং তরল খাদ্য খেয়েছেন। শুক্রবার রাত পর্যন্ত তার অবস্থা অপরিবর্তিত ছিল। চিকিৎসক বলেন যে, ম্যাডামের নতুন করে রক্তক্ষরণ হয়নি। গত ২৮ নভেম্বর ৬ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ মেডিক্যাল টিম সর্বসম্মত মতামত দিয়েছেন যে, খালেদা জিয়াকে বাঁচাতে হলে তার পাকস্থলির রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হবে। আর সেটি করতে হলে তার ট্রান্স জাগুলার ইন্ট্রা হেপাটিক পোর্টো সিস্টেমেটিক শান্ট (Trans jugular intra hepatic porto systematic shunt) বা সংক্ষেপে টিআইপি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করাতে হবে। তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি পৃথিবীর মাত্র তিনটি দেশে আছে। দেশ তিনটি হলো আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং জার্মানি। ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং জার্মানির যত্রতত্র এই চিকিৎসা পাওয়া যায় না। দেশ তিনটিতে হাতে গোনা কয়েকটি অ্যাডভান্স সেন্টার আছে। সেই সব অ্যাডভান্স সেন্টারে টিপস পদ্ধতিতে চিকিৎসা হয়। মেডিক্যাল টিমের সদস্য, বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এফ এম সিদ্দিকী বলেন যে, টিপস পদ্ধতির চিকিৎসা ছাড়া বেগম জিয়াকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, টিপস হলো একটি কৃত্রিম চ্যানেল। যকৃতের (Liver) মাঝে পোর্টাল ভেইনে (Portal vein) রক্ত নির্গমন (Inflow) এবং হেপটিক ভেইনে (Heptic vein) রক্ত নিঃসরণের চ্যানেল হলো টিপস পদ্ধতি। কেউ কেউ এটিকে যকৃতে রক্ত সঞ্চালনের বাইপাস পদ্ধতিও বলে থাকেন।
॥দুই॥
ওপরে চিকিৎসা বিজ্ঞানের টেকনিক্যাল দিক নিয়ে আমাকে দুটি কথা বলতে হয়েছে। না বলে উপায় ছিল না। কারণ আমি এবং সেইসাথে দেশবাসী গভীর মর্মবেদনার সাথে লক্ষ করছে যে, ৭৬ বছর বয়ষ্ক যে বৃদ্ধা মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, তার এই প্রাণঘাতি রোগ নিয়েও রাজনীতি শুরু হয়েছে। একজন ক্যাবিনেট মিনিস্টার বলেছেন যে, বাংলাদেশেও ভালো ডাক্তার আছেন এবং বেগম জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশেই হতে পারে।
বাংলাদেশে যে ভালো ডাক্তার আছেন, একথা কেউই অস্বীকার করবেন না। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক অগ্রগতি সাধন করেছে। বাংলাদেশের ঔষধ এখন পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। এ সবই সত্য। কিন্তু একথাও সত্য যে, ধনিক শ্রেণী এবং দলমত নির্বিশেষে বড় বড় রাজনৈতিক নেতা চিকিৎসার জন্য বিদেশ ছুটে যান। এটা কি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ডাক্তারদের কোয়ালিটির ওপর অনাস্থা অথবা কটাক্ষ নয়? একটি রক্ষণশীল হিসাবে প্রকাশ, ধনিক-বণিকরা নয়, স্বচ্ছল এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তত ২ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দারাবাদ প্রভৃতি শহরে যান। কলকাতা এবং চেন্নাইয়ের রাস্তাঘাটে হাঁটলে আপনি শত শত বাংলাদেশির দেখা পাবেন, যারা চিকিৎসার জন্য ঐসব শহরে গিয়েছেন। অতদূর যেতে হবে না। আপনি ঢাকার ভারতীয় ভিসা অফিসে যান। শত শত লোকের লাইন। তাদের ৯৫ শতাংশ ভিসা চাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য।
যাদের কিছুটা সামর্থ আছে তারা চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন ব্যাংকক, থাইল্যান্ডে। বামরুনগ্রাড হাসপাতালের নাম কে না জানে। আমার আপনার অনেক আত্মীয়-স্বজনই থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যান, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো এক ধাপ ওপরে তারা যাচ্ছেন সিঙ্গাপুর। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের নাম প্রতিটি স্বচ্ছল পরিবারের মুখে মুখে। সবাই যে শুধু মাউন্ট এলিজাবেথেই যান, তা নয়, সেখানে আরো ৪/৫টি হাসপাতাল আছে যাদের চিকিৎসা ব্যয় মাউন্ট এলিজাবেথের চেয়ে অনেক কম, কিন্তু চিকিৎসার মান অনেক উন্নত। প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি অত উন্নতই হবে তাহলে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দারাবাদ, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ছুটছেন কেন? সবচেয়ে বড় কথা, বহুল পরিচিত সমস্যা যথা হৃদরোগ, হিপ এবং হাঁটু প্রতিস্থাপন, অর্থপেডিক্স, জেনারেল সার্জারি ইত্যাদি হেন রোগ নাই যার জন্য মানুষ ইন্ডিয়ায় না যাচ্ছে। অথচ সেগুলোর চিকিৎসা তো বাংলাদেশেই হয়। ইউনাইটেড, এভারকেয়ার, স্কয়ার, ল্যাব এইড প্রভৃতি হাসপাতালে উন্নতমানের চিকিৎসা হয়। তারপরেও চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাত্রার প্রবণতা কেন?
॥তিন॥
ঐ ক্যাবিনেট মিনিস্টার না হয় ডাক্তার নন, জেনারেলিস্ট। কিন্তু তাই বলে বিএমএ বা বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনও এমন লে ম্যানের (খধু গধহ) মত কথা বলবে কেন? তাঁরা এসব বিষয়ে অজ্ঞ, সেটা আমরা অবশ্যই বলবো না। কিন্তু তাদের কেন এই সংকীর্ণতা? চিকিৎসকদের মাঝে তো দলীয় সংকীর্ণতা আসা উচিৎ নয়। বাল্যকাল থেকে একটি ধারণা বুকে লালন করে এসেছি যে, ডাক্তারদের পেশা একটি মাহান পেশা। দুর্গত মানবতার সেবা করার পেশা। বগুড়ায় যখন স্কুল এবং কলেজে পড়তাম তখন এম,বি ডাক্তার ছিলেন তিনজন (পরবর্তীতে এম,বি হয় এম,বি,বি,এস)। এই তিনজন হলেন ডা. মফিজ উদ্দিন, ডা. কাছির উদ্দিন তালুকদার এবং ডা. হাবিবুর রহমান। এদের পসার ভালো ছিল না। কারণ, তারা চেম্বার থেকে বের হতেন না। কিন্তু ডা. ননী গোপাল দেবদাসের ছিল বিরাট হাত যশ, বিপুল জনপ্রিয়তা। ইংরেজ সাহেবদের মত মাথায় হ্যাট পরে সাইকেলে করে তিনি রোগীদের বাড়ি বাড়ি যেতেন। তিনি অসাধারণ জনপ্রিয় ছিলেন। জনশ্রুতি ছিল যে, রোগী ননী বাবুর হাতের ছোঁয়া পেলেই ভালো হয়ে যেত। এই কথায় হয়তো অতিরঞ্জন ছিল। কিন্তু এম,বি ডাক্তারদের কাছে না গিয়ে রোগীরা ননী বাবুকে ‘কল’ দিত।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, রাজনৈতিক বিভাজন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। মানব সেবার মতো মহান পেশায় নিয়োজিত ডাক্তাররাও এর ঊর্ধ্বে নন। ডাক্তারদের সংগঠন আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে আওয়ামী পন্থী বিএমএ। অন্যদিকে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ড্যাব। অতীব দুঃখের বিষয় হলো এই যে, বিএমএ ডাক্তারদের সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতিকে মানব সেবার ঊর্ধ্বে প্রাধান্য দিচ্ছে। বিএমএ তাই বলেছে যে, বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নাকি বাংলাদেশেই সম্ভব। অথচ, বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন যে, বেগম জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে তো দূরের কথা, প্রতিবেশী ভারতেও সম্ভব নয়। তারা আরো বলেন যে প্রতিবেশী ব্যাংকক এবং সিঙ্গাপুরেও বেগম জিয়ার চিকিৎসা সম্ভব নয়। কারণ ঐ দুইটি দেশে প্রয়োজনীয় সাপোর্টিং টেকনোলজি নাই।
॥চার॥
বাংলাদেশ সরকারের অনেক উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি প্রতি বছর হেলথ চেক আপের জন্য সরকারি খরচে লন্ডন যান। হার্টের চিকিৎসার জন্য সরকারি খরচে সিঙ্গাপুর যান। তাহলে তিন বারের প্রধানমন্ত্রী নিজ খরচে দেশের বাইরে যেতে পারবেন না কেন? আদালতে দন্ডিত বলে? জেনারেল জিয়া যখন প্রেসিডেন্ট তখন আ স ম রব ১৪ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন। সেই রব যখন জেলখানায় অসুস্থ হন তখন সরকাররি খরচে প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে চিকিৎসার জন্য জার্মানি পাঠিয়েছিলেন। খরচ হয়েছিল সম্ভবত ৫ লক্ষ টাকা। সেটি আজ থেকে ৪২ বছর আগের কথা। ৪২ বছর আগের ৫ লক্ষ টাকা আজ কত কোটি টাকা?
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করে বেগম জিয়া সুচিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে পারবেন না কেন? তিনি দন্ডিত সেজন্য? তাহলে আওয়ামী নেতা মরহুম নাসিম সিঙ্গাপুর গেলেন কীভাবে? আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুল জলিল বিদেশে চিকিৎসা করেছেন কীভাবে? মহিউদ্দিন খান আলমগীর মন্ত্রিত্ব করেছেন কীভাবে? মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া মন্ত্রিত্ব করলেন কীভাবে? দন্ডিত হওয়ার পরও তারা মন্ত্রিত্ব করেছেন। তাহলে খালেদা জিয়া এত সাফার করবেন কেন? বেগম জিয়াকে অর্থ আত্মসাৎকারী বলা হয়। যে দুই কোটি টাকা আত্মসাতের কথা বলা হয় সেই দুই কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারি কোষাগারে অতিরিক্ত জমা পড়েছে ৬ কোটি টাকা।
বেগম জিয়ার ২ কোটি টাকা নিয়ে এত হৈচৈ। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা যারা পাচার করল তাদের বেলায় সরকার এত খামোশ কেন? কানাডার বেগমপাড়ার শত কোটি টাকা দুর্নীতি এবং পাচারের একটি তালিকা সরকারের হাতে আছে। সেই তালিকায় দুর্নীতিবাজ এবং পাচারকারীদের অপরাধের প্রমাণও নাকি আছে। তারপরেও তারা বহাল তবিয়তে থাকে কীভাবে?
এই তো ১৫ দিনেরও কম সময়ের কথা। খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ কোটি টাকায়। যারা চুনোপুটি, যারা ২৫/৩০ লাখ টাকা ফ্ল্যাট কেনার জন্য ঋণ নেয়, তারা সেই সামান্য ঋণের টাকা শোধ করতে না পারলে বাড়িঘর নিলামে ওঠে। তাদের বাড়িতে পুলিশ যায়। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপী হলেও তাদের টিকিটিও কেউ স্পর্শ করতে পারছে না।
E-mail: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন