শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ১৯শ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মৎস্য অধিদপ্তর

১৬ জেলার ৭৫ উপজেলার জেলে ও মৎস্যজীবীদের জীবনমান উন্নয়ন হবে

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ২:৫৮ পিএম

দেশের উপক’ল ও সন্নিহিত ১৬টি জেলার ৭৫টি উপজেলা সহ সামুদ্রিক নিবিড় অর্থনৈতিক অঞ্চলে জরিপ, মজুদ নিরুপন, সংরক্ষন ও গবেষনা কার্যক্রম সহ মৎস্য সম্পদের যথাযথ উন্নয়নে বিশ^ ব্যাংকের সহাতায় ১৯শ কোটি টাকা ব্যায়ে একটি বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ‘সাসটেইনেবল কোষ্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’ নামে ৫বছর মেয়াদী এ প্রকল্পে বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকেও ৩শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের বিশাল উপক’লভাগের মৎস্য সম্পদের শৃংখলা নিশ্চিতকরন সহ যথাযথ সংরক্ষন, উন্নয়ন ও গুনগত মান বজায় রাখার পাশাপাশি সষ্ঠু বাজারজাত ও মান সম্মত রফতানি নিশ্চিত হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টগন। অতি সম্প্রতি প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বরিশালে এক অবহিতকরন কর্মশালায় গনমাধ্যম কর্মীদের কাছে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ গত দুই দশকে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে তাতে মৎস্য সেক্টরের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মানে মাথাপিছু দৈনিক মৎস্য গ্রহনের পরিমাপ ৬০ গ্রাম হলেও বাংলাদেশে ইতোমধ্যে তা ৬২.৫৮ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। গত এক দশক ধরে সাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশে^ ২য়, ইলিশ আহরনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১ম, তেলাপিয়া উৎপাদনে আমরা বিশে^র ৪র্থ এবং এশিয়ায় ৩য়।
দেশের সাগর উপক’লে আমাদের নিজস্ব ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৬ লাখ ৭০ হাজার টন মৎস্য আহরন সম্ভব হয়েছে। এসময়ে দেশে মোট মৎস্য আহরনের পরিমান ছিল ৪৫ লাখ টনেরও বেশী। সাগরে আহরিত মাছের ৪৫ ভাগ ইলিশ, ৪৯ ভাগ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ এবং চিংড়ির পরিমান ৬ভাগ। ২৫৭টি মৎস্য আহরনকারী নৌযান ছাড়াও প্রায় ৩০ হাজার যন্ত্রচালিত নৌযান বিশাল সাগর উপক’লের নানা প্রজাতির মংস্য আহরনে নিয়োজিত। দেশের প্রায় ৫লাখ মানুষ তাদের জীবন জীবিকার জন্য এখন মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল।
আমাদের দেশে মিঠা পানির মাছের প্রজাতি ২৬০টি হলেও সামুদ্রিক প্রজাতির মাছের সংখ্যা ৪৭৫টি। যারমধ্যে চিংড়ি ৩৬ প্রজাতির, কাঁকড়া ১৫, শামুক ৩০১, ঝিনুক ৬, লবস্টার ৮, প্রবাল ১৩ এবং ডলফিন রয়েছে ১১ প্রজাতির। মৎস্যখাতে রফতানি আয়ের একটি বড় অংশই আসছে সাগরের চিংড়ি ও হাঙরের পাখনা, মাছের পটকা ও কাঁকড়া সহ অন্যান্য হিমায়িত মাছ থেকে।
দেশের সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ছাড়াও সংরক্ষন ও উন্নয়নে সরকার ইতোমধ্যে ৬৫ দিন সাগরে সব ধরনের মাছ এবং মূল প্রজননকালীন ২২ দিন অভ্যন্তরীন ও উপক’লীয় এলাকায় ইলিশ আহরন নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে। ১০ মিটারের গভীরতার মধ্যে বেহুন্দি জাল ব্যবহার সহ নদ-নদী মোহনা ও সমুদ্র উপক’লে চিংড়ী পোনা আহরন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সমুদ্র এলাকায় ‘একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল’ চিঞ্হিত করণে প্রতিবেশী মায়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় আমাদের ‘ব্লুÑইকনমী’ বা ‘সুনীল অর্থনীতি’র বিশাল সম্ভবনা তৈরী হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও এ প্রকল্পটি বিশাল ভ’মিকা পালন করবে বলে মৎস্য বিশেষজ্ঞগন আশা করছেন। প্রকল্পটি জুলাই ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েৎেছ ২০২০ থেকে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নকাল ২০২৫-এর জুন পর্যন্ত বর্ধিত হবার সম্ভবনা রয়েছে। উপক’লীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং মৎস্য চাষ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুদ নিরুপন, সংরক্ষন, সঠিক ব্যবস্থাপনা, টেকসই আহরন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন, চিংড়ি ক্লাস্টার সহ উপক’লীয় প্রান্তিক জেলে সম্প্রদায়ের জীবনমানের উন্নয়নই প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে জানা গেছে।
এ লক্ষ্যে বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনান, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠী, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা,যশোর, বাগেরহাট, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম জেলার ৭৫ টি উপজেলা ও সন্নিহিত এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। ঢাকায় প্রকল্প পরিচালকের সরাসরি তত্বাবধানে বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামে ৩জন উপ-প্রকল্প পরিচালক এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছেন।
প্রকল্পটিকে ৪টি কম্পোনেন্ট-এ বিভাজন করা হয়েছে। মৎস্য সেক্টরে টেকসই ব্যবস্থাপনা এবং সে লক্ষে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, অবৈধ অজানা ও নিয়ন্ত্রনহীন পদ্ধতিতে মৎস্য আহরন বন্ধে মনিটরিং কন্টোল সার্ভিলেন্স সিস্টেম চালু করা হবে। মৎস্য সেক্টরের বিদ্যমান বিধিÑবিধান যুগোপোযুগী করা, বনিজ্যিক ট্রলারে ভ্যাসেল মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করে নজরদারী জোরদার, যান্ত্রিক নৌকায় সয়ংক্রিয় শণাক্ত করন ব্যাবস্থা চালু করাও প্রকল্পের উদ্দেশ্য । এছাড়া রিসোর্স ম্যাপিং সমুদ্রে মৎস্য সম্পদের মজুদ নিরুপন সহ নিয়মিত পরিবীক্ষণ, নিয়ন্ত্রন ও তত্ববধানের পাশাপাশি মৎস্য আহরনে অন-লাইন রেজিস্ট্রেশন সহ লাইসেন্স পদ্ধতি বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে। হাইস্পীড পেট্রোল বোটের মাধ্যমে সমুদ্রে নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
প্রকল্পের আওতায় মৎস্য আহরন ও চাষে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মৎস্যখাতের জন্য ভ্যালু চেইন এবং নিরাপদ খাদ্য বিধান সহ খামার সুরক্ষা ও সম্প্রসারন করা হবে। পাশাপাশি মেরিন ভ’-আঞ্চলিক কর্ম পরিকল্পনা প্রনয়নের মাধ্যমে হাইড্রোলজিক্যাল জরিপ, স্যালানাইনেজশন ম্যাপিং ও খাল পূণর্বাসনে লক্ষ্যে উপক’লের ২৯টি খালের ৫শ হেক্টর পুণঃখনন করা হবে। চিংড়ী উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে ১৫ হাজার প্রান্তিক চাষিকে ৬শ টি ক্লাস্টারে উন্নয়ন করা হবে। এরফরেল উপক’লীয় এলাকায় চিংড়ির উৎপাদন অন্তত ২০ভাগ বাড়বে বলে উপ-প্রকল্প পরিচালক কামরুর ইসলাম জানিয়েছেন।
প্রকল্পের আওতায় ফিশারিজ সার্ভিল্যান্স চেকপোষ্ট নির্মান ছাড়াও ১৮টি ফিস ল্যান্ডিং সেন্টার বা ফিস হারবার নির্মান ছাড়াও ফিস মার্কেট পূনর্বাসন ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে আহরন ও উৎপাদন অবচয় কমিয়ে আনা হবে। এছাড়াও ৩টি করে ফিস কোয়ারেন্টাইন ল্যাব, ফিস ডায়গনস্টিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ৩টি পিসিআর ল্যাব নবায়ন ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। একই সাথে ১টি করে কোয়ারেন্টাইম রেফারেন্স ল্যাব ও ব্রুড ম্যানেজমেন্ট সেন্টার স্থাপন করা হবে।
বরিশালে ২৯০টি সহ উপক’লীয় সাড়ে ৪শ গ্রামে মৎস্যজীবীদের জন্য কমিউনিটি সেভিংস গ্রুপ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ১শ মডেল জেলে পল্লী প্রতিষ্ঠা করা হবে। এরমধ্যে ৬০ ভাগ সুবিধাভোগীকে অর্থ সহায়তাও প্রদান করবে মৎস্য বিভাগ। এসব মডেল গ্রামের ১৮ হাজার যুবক ও যুব মহিলাকে ভকেশনাল ও দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষন প্রদান সহ ১শ প্রডিউসর গ্রুপ তৈরী করা হবে। এসব এলাকায় ৯০টি যুব মেলা সহ ৬টি জব ফয়ারেরও আয়োজন করা হবে। ৪৫টি উপজেলায় জেলে ফেডারশন প্রতিষ্ঠা করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করা হবে প্রকল্পের আওতায়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যেসব অবকাঠাওমো নির্মান সহ খাল খনন, বাজার উন্নয়ন সংযোগ সড়ক নির্মন এবং কøাস্টার ফার্মের উন্নয়ন করা হচ্ছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হচ্ছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল জানিয়েছেন।
সিমিত তহবিল, স্বল্পসময়ে কাঙ্খিত জিডিপি অর্জন এবং ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রকল্পটি ইতিবাচক ভ’মিকা রাখবে। এমনকি দেশের রফতানি আয় বৃদ্ধি সহ দারিদ্র বিমোচনের দুরুহ লক্ষেও যথেষ্ঠ সহায়ক ভ’মিকা পালনে আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন প্রকল্প পরিচালক সহ সংশ্লিষ্টগন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন