বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় তৎকালীন ছাত্রলীগের ২০ নেতা-কর্মীকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বুধবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ওরফে শান্ত, বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার অপু, সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির, সাবেক ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, তৎকালীন সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-দফতর সম্পাদক মুস্তবা রাফিদ এবং সদস্য মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, মুনতাসির আল জেমি, ইহতাশামুল রাব্বী তানিম, ছাত্রলীগ কর্মী খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর, এ এস এম নাজমুস সাদাত, মাজেদুর রহমান ওরফে মাজেদ, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, শামীম বিল্লাহ, মুহাম্মদ মোরশেদ-উজ-জামান মন্ডল ওরফে জিসান, মোরশেদ অমর্ত্য ইসলাম, মিজানুর রহমান মিজান, শামসুল আরেফিন রাফাত ও এস এম মাহমুদ সেতু। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে জিসান, তানিম ও মুস্তবা রাফিদ পলাতক রয়েছেন। রায় ঘোষণাকালে পলাতক তিনজন ছাড়া বাকিদের উপস্থিতিতেই ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় ২২ আসামিকে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় আনা হয়।
রায়ে মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। যাবজ্জীবনপ্রাপ্তরা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহতাসিম ফুয়াদ, তৎকালীন গ্রন্থাগার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ মুন্না, সাবেক আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা, সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী আকাশ হোসেন ও মোয়াজ আবু হুয়ারেরা। একই সঙ্গে আদালত তাদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন। রায় ঘোষণার পর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
যেভাবে হত্যা করা হয় আবরারকে : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি ও গ্যাস চুক্তির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। ওই দিনই শেরেবাংলা হলের গেস্টরুমে আসামিরা সভা করে বুয়েটের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র আবরারকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। স্ট্যাটাসটি দেয়ার সময় আবরার কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি ছিলেন। পরদিন ৬ অক্টোবর বিকেলে তিনি ঢাকায় বুয়েট হলে ফেরেন। কয়েক ঘণ্টার মাথায় রাত ৮টার দিকে আবরারসহ দ্বিতীয় বর্ষের ৭-৮ জন ছাত্রকে শেরেবাংলা হলের দোতলার ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাত-আটজন নেতা।
তারা আবরার ফাহাদের মোবাইল নিয়ে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে দেখেন। এরপর ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আরো কয়েকজন নেতাকর্মী আসেন। তারা আরেক দফা পেটান আবরারকে।
প্রাথমিক তদন্তের পর সে সময় একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন আবরার। যেখানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি ও গ্যাস চুক্তির বিষয়ে একরকম ভিন্নমত পোষণ করেন আবরার। সেই স্ট্যাটাস ইশতিয়াক মুন্নার নজরে আসে।
তিনি একই হলের শিক্ষার্থী বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, উপ-দফতর সম্পাদক মোস্তফা রাফি, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা, ক্রীড়া সম্পাদক মেজবাউল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকারকে বিষয়টি জানিয়ে আবরারকে ডেকে আনার নির্দেশ দেন। তারা সবাই ১৬ ও ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে দু’জন রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আবরারকে ডেকে ২০১১ নং কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে নেয়ার পর আবরারের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে তার ফেসবুক মেসেঞ্জার চেক করে মুন্না। এ সময় আবরার শিবিরের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ আনা হয়। আবরার এসব অস্বীকার করলে শুরু হয় স্টাম্প দিয়ে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন।
বেধড়ক পেটানো হয় তাকে। মার খেয়ে একপর্যায়ে আবরার অচেতন হয়ে পড়লে কোলে করে মুন্নার কক্ষে (২০০৫ নং) নেয়া হয়। সেখানে অবস্থার আরো অবনতি হলে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মধ্যবর্তী জায়গায় অচেতন আবরারকে নিয়ে যান তারা। অচেতন আবরারের চিকিৎসার জন্য হল প্রভোস্ট ও চিকিৎসককে খবর দেয় ছাত্রলীগের সেসব কর্মী। কিন্তু এরই মধ্যে প্রাণ হারান আবরার। চিকিৎসক এসে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন। তখন কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দেয়।
তদন্ত ও দ্রুত বিচার : আলোচিত এ ঘটনায় আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত শেষে গত বছর ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। চার্জশিটে ২৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ১১ আসামি সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নেয়। বাকি ১৪ জনকে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ততার কারণে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গত বছর ২১ জানুয়ারি চার্জশিট গ্রহণ করেন আদালত। একই বছর ১৮ মার্চ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েস মামলাটি বদলির আদেশ দেন। এর পর একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠনের মাধ্যমে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। চলতি বছর গত ১৪ মার্চ এ মামলায় কারাগারে থাকা ২২ আসামি আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। অপর তিন আসামি পলাতক থাকায় আত্মপক্ষ শুনানি করতে পারেনি। এর পর কয়েকজন আসামি নিজেদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যও দেন। ৭ সেপ্টেম্বর মামলায় কিছু ত্রুটি থাকায় সরকারপক্ষ পুনরায় চার্জ গঠনের আবেদন করে। ৮ সেপ্টেম্বর আদালত ২৫ আসামির বিরুদ্ধে পুনরায় চার্জ গঠনের আদেশ দেন। ১৪ সেপ্টেম্বর আত্মপক্ষ শুনানিতে ২২ আসামি আবারও নিজেদের ‘নির্দোষ’ দাবি করেন। পরে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য প্রস্তুত হয়।
চার্জশিটে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে শিবির সন্দেহে আবরারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নির্মমভাবে পিটিয়ে তাকে হত্যা করে। চার্জশিটে আবরার ফাহাদ রাব্বী হত্যা মামলায় আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান ওরফে মিজানকে হত্যার মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনিই আবরারকে শিবির বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
পরে শেরেবাংলা হলের গেস্টরুমে কয়েকজন আসামি সভা করে এ হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চার্জশিটে অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৯ জন এবং তদন্তে আগত ৬ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া অভিযুক্তদের মধ্যে ৮ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সন্তোষ কৌঁসুলি ও আইনমন্ত্রীর : গতকাল রায় ঘোষণার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন আবরারের পক্ষে সরকার নিযুক্ত বিশেষ কৌঁসুলিরা। অন্যদিকে অসন্তোষ প্রকাশ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। আবরার হত্যায় সরকারপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের মানুষকে ব্যথিত করেছে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকান্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর কখনো না ঘটে, তা রোধকল্পে ট্রাইব্যুনাল আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। ৪৬ জন সাক্ষী আমরা এখানে হাজির করেছি। যারা উপস্থিত ছিলেন, ঘটনা দেখেছেন তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন।
তবে আসামিপক্ষ দাবি করেছে রায় সঠিক হয়নি। আসামিপক্ষের অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ বলেন, ‘যারা মাস্টারমাইন্ড ছিল তাদের এই মামলায় আনা হয়নি। এই মামলায় বুয়েটের যে নেগলিজেন্সি ছিল আমরা আজকে মনে করেছিলাম এই বিষয়গুলো আমরা যুক্তিতর্কের সময় উপস্থাপন করেছি। মাননীয় বিজ্ঞ বিচারক তিনি হয়তো জাজমেন্টে আনবেন। কিন্তু দেখা যায় কোনো কিছু না এনে তিনি আমাদের ২০ জন আসামিকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। ৫ জনকে যাবজ্জীবন দিয়েছেন। আমরা মনে করি জাজমেন্ট সঠিক হয়নি। আমরা আসামিদের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে যাব।
রায় সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আবরার হত্যা মামলার রায়ে প্রকৃত ও ন্যায়বিচার করা হয়েছে৷ রাষ্ট্রপক্ষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে দ্রæত সময়ের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করায় ধন্যবাদ জানাই। আবরার হত্যা মামলার রায়ে এটা প্রমাণ হয় যে, দেশে আইনের শাসন রয়েছে।
বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ে ন্যায়বিচার হয়েছে। রাজধানীর গুলশানে নিজ কার্যালয়ে গতকাল বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
অমিত সাহার মৃত্যুদন্ড না হওয়া আক্ষেপ মায়ের : এদিকে রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আবরার ফাহাদের পিতা মো. বরকতউল্লাহ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তবে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে রায় যেদিন কার্যকর হবে সেদিন পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারবেন বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, এই রায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে কার্যকর করা হবে আমরা সেটাই আশা করছি। অতিদ্রুত যেন এ রায় কার্যকর করা হয়।
এদিকে ইনকিলাবের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, রায়ের কথা শোনার পর আবরারের মা রোকেয়া খাতুন অঝোরে কাঁদছিলেন। স্বজনরা তাকে সান্ত¦না দিচ্ছেন। তিনি বলেন, হত্যাকান্ডের মূল হোতা অমিত সাহা হত্যাকান্ডের সময় ঘটনাস্থলে না থাকলেও মোবাইলের মাধ্যমে সে হত্যাকান্ডের সব পরিকল্পনা করেন। অথচ তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়নি। কিভাবে সে মৃত্যুদন্ড থেকে বাদ যায়-আমি বুঝতে পারলাম না!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন