আমরা যারা সাংবাদিক তারা কেউ কিন্তু বড়লোক নই। বড়লোক তো দূরের কথা, স্বচ্ছলও নই। দু’চার বছর আগেও ভাবতাম, আমরা মধ্যবিত্ত। কিন্তু এখনকার দৈনন্দিন খরচ দেখে বুঝতে পারি, আমরা মধ্যবিত্ত নই। আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত। আমরাই আমাদের কলম দিয়ে লিখি যে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে। জিডিপি বেড়েছে। পারক্যাপিটা বা মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অর্থনীতির আকার, আয়তন বা সাইজ বেড়েছে। এগুলো সবই সত্য। কিন্তু তারপরেও শুধু সাংবাদিক নন, সরকারি ও বেসরকারি খাতের কেরানী, পিওন ও জুনিয়র অফিসার যখন বাসা ভাড়া নিতে চান তখন তাদের ব্রহ্মতালু গরম হয়ে ওঠে। মুরগীর খুপরির মতো দুই আড়াই বা তিন রুমের বাড়ি ভাড়া ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা। তিনি বেতন পান কত? বেতনের অর্ধেক বা তার বেশি তো খেয়ে ফেলবে বাসা ভাড়া। তারপর? পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা করাতে হবে না? এখন আর কেউ সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। বলেন, ওরা ঠিকমত জানেন না। এফসিপিএস ডাক্তার ছাড়া এখন মানুষের ভরসা নাই। করোনা ভাইরাস তথা প্যান্ডেমিকে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের বেতন কমে গেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই করোনা মহামারিতে ডাক্তার সাহেবদের ভিজিট বেড়েছে। টেবিলের ওপর চারিধারে নির্মিত কাঁচের ঘেরাটোপের মধ্যে তারা বসে থাকেন। তারা নিজেরা সিট থেকে ওঠেন না, রোগীর ব্লাড প্রেসার মাপেন না, পালস দেখেন না, স্টেথু লাগান না। এগুলো করে এখন তার কম্পাউন্ডার বা ওই ধরনের কেউ। কিন্তু ডাক্তার সাহেব তাঁর ভিজিট ঠিকই বাড়িয়েছেন। ১০০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১২০০ টাকা, ১২০০ হয়েছে ১৫০০ টাকা, আর ১৫০০ টাকা হয়েছে ১৮০০ টাকা। এখানেই শেষ নয়। সাথে দেবেন একগাদা পরীক্ষা। পরীক্ষার খরচ কম করে হলেও ৩৫০০ টাকা। যদি পরিবারের ২ জন সদস্যকেও ডাক্তার দেখাতে হয়, তাহলে তার অবস্থা কত করুণ হতে পারে সেটা কল্পনাও করা যায় না।
শুধু তো বললাম বাসা ভাড়া আর চিকিৎসা খরচ। সারা মাসের অন্যান্য খরচ? পোশাক-পরিচ্ছদ, খানা-খাদ্য, রিকশা, বাস ও সিএনজি ভাড়া, স্কুল কলেজ ভার্সিটির ফিস- এসব কিছু মেটাতে গিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। মাসের পয়লা গিন্নী একটি ফর্দ বানান। সারা মাসে কোন খাতে কত খরচ। তার পাশে তাদের ইনকাম বা আয়। দেখা যায়, ইনকাম দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। সুতরাং খরচের খাত কাটবেন বা ছোট করবেন। কিন্তু কত আর কাটা যায়? কত আর ছোট করা যায়? এক সময় গিন্নী বলেন, এভাবে জোড়াতালি দিয়ে আর কত চলবো? আর তো পারছি না।
॥দুই॥
কিছুদিন আগে ডিজেল এবং কেরসিনের দাম বাড়ানো হয়। তখন চারদিক থেকে প্রতিবাদ হয়। বলা হয় যে, এর ফলে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বৃদ্ধি পাবে। প্রতিবাদী কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছিল যে, শুধুমাত্র ডিজেলের দাম বৃদ্ধিই যত অনিষ্টের মূল। শুধুমাত্র জ্বালানির দাম বৃদ্ধিই কি অন্যান্য জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির কারণ? সেটিই একমাত্র কারণ নয়। আসলে বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধির জন্য কোনো কারণের প্রয়োজন হয় না। এই যে এখন পিঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়ানো হয়েছে, তার পেছনে কোনোরকম যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। এর আগে ভারতীয় পিঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাকে একটি যুক্তি হিসাবে খাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু এবার? সেই যুক্তি নেই। তাছাড়া ফলনও ভালো হয়েছে। শনিবার একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকে ছবি দেখলাম, বাজারে শাকসবজির প্রচুর সরবরাহ। পরিবহনেও কোনো সমস্যা নাই। তারপরেও শাকসবজির বাজারেও আগুন। এক সময় বলা হতো, মাছ-মাংস মহার্ঘ। অতএব, শাকসবজি খাও। শাকসবজি দামেও সস্তা, আছেও প্রচুর প্রোটিন ও ভিটামিন। সেই শাকসবজিতেও হাত দিতে পারবেন না। তাহলে আপনি কী খাবেন? আসলে ‘কী’ও খেতে পারবেন না।
সরকার রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনে কঠোরহস্ত। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো বাপ-মা নেই। সিএনজিতে মিটার বসানো হলো। কিন্তু কেউ কি মিটারে যায়? সিএনজি আগে যখন ছিল স্কুটার বা বেবি ট্যাক্সি তখনও মিটার বসানো হয়েছিল। তখনও কোনো যন্ত্র চালিত ত্রিচক্র যান মিটার মানেনি, আজও মানে না। আপনি ট্রাফিক পুলিশ বা প্যাট্রোল পুলিশকে বলবেন? কোনো লাভ নাই। তারা বলবে, ভাই, ওদের সাথে ‘ভাও’ করেন। আমার বাড়ি থেকে ল্যাবএইড ৫/৭ মিনিটের পথ। প্রথম দিকে রিকশা ভাড়া লাগতো ১০ টাকা। মাত্র চার বছরের ব্যবধান। এখন ভাড়া ৫০ টাকা।
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে আর ওরাও ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়িয়ে পুষিয়ে নেয়। কিন্তু এই তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী আর জুনিয়র অফিসাররা? তাদের বেতন বাড়লে বাড়ে বছরে বড় জোর ৫০০ টাকা। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে অর্থনীতির কোনো সূত্র বা নিয়ম রীতির তোয়াক্কা না করে দাম বাড়ানো হয়। দেখার কেউ নাই। আজ আমি অর্থনৈতিক পরিভাষা ব্যবহার না করার চেষ্টা করছি। তবুও বলতে হয়, বাজার পরিস্থিতি মনিটর করার জন্য সরকারের কোনো অর্গান থাকবে না? এই যে ডিজেলের দাম বেড়ে গেলো, আর সাথে সাথে বাসভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেলো। কিন্তু কয়টা বাস ডিজেলে চলে? নগরপবিহনের অধিকাংশ বাসই তো চলে প্রাকৃতিক গ্যাসে। তাহলে ঐ বাসগুলোর ভাড়া বাড়লো কেন? আর সরকার নীরবে সেটা মেনে নিলই কেন?
॥তিন॥
আমি প্রথমেই বলেছি, এখনও বলছি, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বাংলাদেশেও ডিজেল ও কেরসিনের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে যা বলা হয় সেটা একটা বাহানা মাত্র। মন্ত্রী বলেন, দাম বাড়ানো হয়নি, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করা হয়েছে মাত্র। এই সমন্বয় অর্থ মূল্যবৃদ্ধি। আচ্ছা, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানির দাম কমে যায়, তখন সমন্বয়ের অর্থ কী দাঁড়ায়? মূল্যহ্রাস। তাই নয় কি? একবার কোনো জিনিসের দাম বেড়ে গেলে, সেই জিনিসের দাম ফের কমেছে, বিগত ৫০ বছরে এমন কোনো নজির আছে কি? বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে তেলের দাম অনেকবার উঠেছে, আবার অনেকবার নেমেছে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম পড়ে যায় তখন বাংলাদেশে কি তেল বা জ্বালানির দাম কমেছে?
১৯৯০ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ডিজেলের দাম ছিল ১৭ টাকা লিটার। ২০০৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ২৩ টাকা লিটার। ৬ মাস পর ২০০৫ সালের ২৫ মে ২৬ টাকা লিটার। ৬ মাস পর ২০০৬ সালের ৫ জানুয়ারি ৩০ টাকা লিটার। পুনরায় ৬ মাস পর ৯ জুন ৩৩ টাকা লিটার। ১০ মাস পর ২০০৭ সালের ২ এপ্রিল ৪০ টাকা লিটার। ১৫ মাস পর ২০০৮ সালের ১ জুলাই ৫৫ টাকা। অর্থাৎ এক লাফে ১৫ টাকা বৃদ্ধি। এখন সেটি ৮০ টাকা লিটার। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ পরিবেশিত এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, মাঝখানে বেশ কয়েক বছর বিশ্ব বাজারে মূল্যহ্রাস পেয়েছিল। তখন তো সরকার সমন্বয় করেনি। অর্থাৎ দাম কমায়নি। না কমানোর ফলে ওই কয়েক বছর বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) তথা সরকার ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। সরকার যদি ভর্তুকি অব্যাহত রাখতো তাহলে এবার দাম না বাড়িয়েও ২০ বছর ভর্তুকি দেয়া সত্ত্বেও চালিয়ে নেয়া যেতো।
E-mail: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন