পুলিশ বাহিনী এবং বিভিন্ন এজেন্সীর মধ্যে পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং উত্তেজনা বিরাজ করার কারণে এক বিভাগের কাজ অন্য বিভাগের কাজকে বিঘিœত করছে। এনিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই উদ্বিগ্ন। তারা মনে করছেন, এ ধরনের প্রবণতায় অনেক ক্ষেত্রেই চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ছে। সমন্বয়রের অভাবে একই ঘটনার ব্যাপারে একেক বিভাগ একক রকম রিপোর্ট দিচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর এবং র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মধ্যকার দ্বন্দ্ব পুনরায় উঠে আসায় পরিস্থিতি ভিন্ন আকার নিয়েছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর র্যারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, অবস্থা এতটাই খারাপ যে, যে কোন সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বলা হয়েছে, কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা র্যাব সদস্যদের লাঠি এবং রাইফেল দিয়ে আঘাত করছে। এধরনের ৬টি ঘটনার উল্লেখ করে দেয়া চিঠির তদন্ত করছে পুলিশ সদর দপ্তর। র্যাব-পুলিশ দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, এগুলো পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তিনি আরো বলেছেন, এটা তারাই মিটিয়ে নেবে। অন্যদিকে পুলিশের মহাপরিচালক একেএম শহিদুল হক বলেছেন, র্যাব-পুলিশ সদর দপ্তরকে বাইপাস করতে পারে না। একজন এসপি জানিয়েছেন, প্রতিযোগিতা যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপান্তরিত হয় তখনই সমস্যা দেখা দেয়। র্যাবের ডিজি বেনজির আহমেদ মনে করেন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অধিকতর সমন্বয় জরুরি।
কেন এবং কোন বাস্তবতায় র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের জন্ম হয়েছিল তা নতুন করে বলার কিছু নেই। শুধু এইটুকু বলা জরুরি, দেশে দ্রুত অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্য নিয়েই এই বিশেষ বা এলিট ফোর্স গঠন করা হয়েছিল। শুরু থেকেই এই বাহিনী অধিকতর সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে। বাহিনীর নামকরণ নতুন হলেও এ বাহিনী মূলত বিভিন্ন বাহিনী থেকে সদস্য নিয়েই গঠন করা হয়। বিভিন্ন বাহিনী থেকে দক্ষ সদস্য নিয়ে র্যাব গঠন করার মূল লক্ষ্য ছিল, যে কোন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ দক্ষতা নিশ্চিত করা। সে সময়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, সন্ত্রাসী বাহিনী দমনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই তথ্য সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে যেত। এখন পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গত কয়েক বছরে এই বাহিনী নিয়েও নানা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবে একথা না বললেই নয় যে, এই বিশেষ বাহিনী গঠনের ব্যাপারটি শুরু থেকেই পুলিশের কোন কোন মহল ভাল চোখে দেখেনি। এখন দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি অনেকটাই প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বহুল আলোচিত ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা হত্যাকা-ের ব্যাপারে পুলিশ যখন বিএনপির সদস্যদের দায়ি করছে তখন র্যাব বলছে, এটা করেছে পুনঃগঠিত জমিয়াতুল মুজাহিদিনের সদস্যরা। এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসকমুনিকেশন এবং সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান মো. মফিজুর রহমান মনে করেন, এধরনের ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি করবে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশ্বস্ততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ব্যাপারটি শুধু যে কেবল র্যাব-পুলিশের মধ্যেই সীমবদ্ধ তা কিন্তু নয়। দেখা যাচ্ছে, পুলিশের বিভিন্ন বাহিনী যেমন বিশেষ বাহিনী, সিআইডি, এনএসআই ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের মধ্যেও সক্রিয় রয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব অথবা তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্র পড়তে বাধ্য। দেশের বিনিয়োগ থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হবে। এছাড়াও নাগরিক নিরাপত্তার বিবেচনাতেও এটি মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচিত। সমন্বয় না থাকলে কে কি করছে তার কোন বিবরণ পাওয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চেইন অব কমান্ড এবং জননিরাপত্তার জন্য অশনি সংকেত।
বাহিনীগুলো নিজেরাই তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মিটিয়ে নেবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এধরনের বক্তব্য দেয়ার পরও বিরোধের অবস্থিতি উদ্বেগজনক। ফলে সঙ্গত এবং বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, কেন এঅবস্থা তৈরি হয়েছে তা অনুসন্ধান করা জরুরি। গত কয়েক বছরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নানামুখী খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যমান বাস্তবতার পিছনে অন্তর্নির্হিত কোনো কারণ রয়েছে কিনা তাও খুঁজে দেখা দরকার। কারণ যাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী ও এজেন্সীগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ যেমনি নেই, তেমনি এড়িয়ে যাবারও কোন সুযোগ নেই। এদের মধ্যে সমন্বয় ও চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রলম্বিত হলে আইন-শৃঙ্খলাসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন