শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ইসলামে বিজয়ের তাৎপর্য

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

১৬ ডিসেম্বর, আমাদের বিজয় দিবস। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির শোষণ থেকে এ দিনে মুক্তি লাভ করে বাংলার মানুষ। এ বিজয় শুধু আনন্দের নয়, পরাধীনতার কবল থেকে মুক্তি লাভের বিজয়। পৃথিবীর সব ধর্ম-দর্শনে স্বাধীনতার অশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলামেও রয়েছে আজাদি তথা স্বাধীনতার অপরিসীম গুরুত্ব। বিজয় এবং স্বাধীনতা মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। ইসলাম চায় সকল মানুষ যেনো শান্তিপূর্ণ ও স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারে। ইসলাম আমাদেরকে এই শিক্ষাই দেয়, আমরা যেনো আমাদের ভূখণ্ড তথা মাতৃভূমিকে অত্যধিক ভালোবাসি। তাই বলা যায়Ñ দেশপ্রেম, রাষ্ট্রের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা হচ্ছে, মুসলমানদের চরিত্র। রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো সত্যিকার ঈমানদার গাদ্দারি করতে পারে না। ইসলামে বিজয় ও স্বাধীনতার তাৎপর্য অপরিসীম। স্বাধীনতার ইসলামি স্বরূপ হচ্ছে, মানুষ মানুষের গোলামি করবে না; বরং একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তার গোলামি করবে।

দেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস, বিশেষত মুসলমানদের প্রতিটি রক্ত-কণিকায় দেশপ্রেমের শিহরণ থাকা বাঞ্ছনীয়। মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো, তার ভূখন্ড ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা। কেননা রাসুল (সা.) ছিলেন দেশপ্রেমিকের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। রাসুল (সা.) যখন অত্যাচারী কাফেরদের কারণে স্বীয় মাতৃভূমি মক্কা নগরী ত্যাগ করে মদিনায় পাড়ি জমাচ্ছিলেন, তখন তাঁর চোখ থেকে অশ্রু বয়ে যাচ্ছিলো। তিনি মক্কার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিতো, কখনও আমি তোমাকে ত্যাগ করতাম না।’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা : ২৬৩৫, তাফসিরে ইবনে কাসির : ৩/৪০৪)। অপরদিকে হিজরতের পর রাসুল (সা.) মদিনা নগরীকেও খুব ভালোবেসেছেন। কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে ওহুদ পাহাড় চোখে পড়লে রাসুল (সা.)-এর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠতো। তিনি বলতেন, ‘এই ওহুদ পাহাড় আমাদেরকে ভালোবাসে এবং আমরাও ওহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি।’ (বোখারি : ২/৫৩৯, মুসলিম : ২/৯৯৩)।

দেশপ্রেমের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হলো, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর পথে একদিন ও একরাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া এক মাস পর্যন্ত সিয়াম পালন ও এক মাস ধরে রাতে নামাজ আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিলো, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে; তার রিজিক অব্যাহত থাকবে, কবর-হাশরের ফেৎনা থেকে সে নিরাপদ থাকবে। ’ (মুসলিম : ১৯১৩)। অতএব, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতা ও এই বিজয়কে অর্থবহ করতে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা, দেশ ও দেশের মানুষকে ভালো কিছু দেওয়ার মনমানসিকতা তৈরি করা উচিত।

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওযি (রহ.) তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘যাদুল মাআদ’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লেখ করেন, ‘দশম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল (সা.) একটি উষ্ট্রীর ওপর আরোহিত ছিলেন। তাঁর চেহারা ছিলো নিম্নগামী। আল্লাহর দরবারে বিনয়ের সঙ্গে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন। প্রথমে তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এই নামাজকে বলা হয় ‘বিজয়ের নামাজ’। এরপর তিনি হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।’ তিনি বলেন, ‘হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! তেরো বছর ধরে আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবা (রা.)-এর ওপর নির্যাতনের যে স্টিম রুলার চালিয়েছো, এর প্রতিবদলায় আজ তোমাদের কী মনে হয়, তোমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবো?’ তারা বললো, ‘হ্যাঁ, আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনি আমাদের উদার ভাই, উদার সন্তান। আপনি আমাদের সঙ্গে উদারতা ও মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি আজ তোমাদের সবার জন্য হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও, তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না।’ (সুনানে বায়হাকি : ৯/১১৮)।

প্রত্যেক জাতিরই বিজয় রয়েছে, মুসলমানেরও আছে। কিন্তু মুসলমানের বিজয় নানা দিক থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। চিন্তা-আদর্শ, মূল্যায়ন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মপন্থাসহ সব দিক থেকেই ভিন্ন মাত্রা ও ভিন্ন রকমের। কোরআনে কারিমে বিজয়ের দুটি রূপ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছেÑ এক. স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয়, দুই. কল্যাণকামী ও আদর্শবাদী বিজয়। প্রথমটির ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘রাজা-বাদশাহ যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে, তখন তা বিপর্যস্ত করে। সেখানকার মর্যাদাবান লোকদের অপদস্থ করে।’ (সুরা নামল : ৩৪)। এ ধরনের যুদ্ধ ও যুদ্ধজয় যত দেশে হয়েছে, সেখানে কত জনপদ তছনছ হয়েছে, কত মানুষের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, কত নারীর সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এ কারণে বিজয়ের এ ধরনটি মানবতার বিজয় নয়, প্রকৃত বিজয় নয়।

বিজয়ের আরেক রূপের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি এদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা নামাজ আদায় করবে, জাকাত দান করবে এবং সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর সব কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন।’ (সুরা হজ : ২২)। এ ধরনের বিজয় হচ্ছে সত্য ও আদর্শের বিজয়। মানব-মানবতা ও সততার বিজয়।

আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘(হে নবী!) যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবে, তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করো; তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল।’ (সুরা নাসর : ১-৩)। মহান রাব্বুল আলামিন বিজয় দিবসে তিনটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এক. ফাসাব্বিহ (আল্লাহর তাসবিহ পাঠ তথা পবিত্রতা বর্ণনা করা), দুই. বিহামদি রাব্বিক (আল্লাহর হামদ তথা শোকরিয়া আদায় করা), তিন. ওয়াস্তাগফির (যুদ্ধের সময় ভুল-ভ্রান্তি তথা সীমালঙ্ঘন থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা)। স্বাধীনতা ও বিজয় একমাত্র মহান করুণাময় আল্লাহতায়ালারই দান। আল্লাহর অশেষ করুণার বদৌলতেই আমরা এ বিজয় করতে পেরেছি। তাই শোকরিয়াও আদায় করতে হবে একমাত্র তাঁরই।

আর হাদিস থেকে জানা যায়, বিজয় দিবসে আট রাকাত নামাজ আদায় করা, যুদ্ধে নিহতদের জন্য ইস্তেগফার-দোয়া ও কোরআন পাঠসহ বিভিন্নভাবে ইসালে সওয়াব করা কর্তব্য। কেননা মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল (সা.) দশ বছর পর শত-সহস্র সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর বিশাল বহর নিয়ে যখন পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি বিজয় মিছিল বা শোভাযাত্রার কিছুই করেননি; গর্ব-অহঙ্কার করেননি; বাদ্য-বাজনা বাজাননি; কারও সমাধি বা মিনারে পুষ্পস্তবকের আয়োজন করেননি।
লেখক: কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন