পরিকল্পিতভাবে বালু তোলার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের এক অনির্ধারিত বৈঠকে তিনি আরো বলেছেন, নদীর বালু যত্রতত্র থেকে তোলার ফলে সেতু ও ফসলের মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও নদীরপাড় ভাঙনসহ পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রধানমন্ত্রী ভূমি, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ, পানিসম্পদ ও নৌ পরিবহন এই চারটি মন্ত্রণালয়কে সুনির্দিষ্ট এলাকা থেকে বালু তোলার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ক্ষতির বিষয়টি এড়িয়ে এ ধরনের কাজ করা উচিত। এ জন্য তিনি চারটি মন্ত্রণালয়কে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডেকে একটি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তিনি আরো বলেছেন, ভূ-উপগ্রহের সাহায্য নিলে নদীর তলদেশ বা কোথা থেকে বালু উত্তোলন করলে এ ধরনের ক্ষতির বিষয়টি এড়ানো যাবে, তা জানা যাবে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে প্রতিবেশীর বৈরী পানিনীতির কারণে এখন প্রায় পানিশূন্যই থাকছে। পানির অভাবে নদ-নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। প্রতিবছরই দেখা যাচ্ছে বর্ষায় উজানের পানিতে বন্যা আর শুষ্ক মওসুমে পানির অভাবে নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বর্ষায় যে পরিমাণ পলি প্রতিবছর জমা হয় সারা বছর নদ-নদীর নাব্যতা না থাকার কারণে তার অল্প পরিমাণই সাগরে যেতে পারে। ফলে তা জমা হয়ে থাকে এবং নদীর স্বাভাবিক চলা রুদ্ধ করে দেয়। নদ-নদীতে পলি জমার ব্যাপারটিতে কার্যত নতুনত্ব কিছু নেই। আগেও বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বালু তোলার অনুমতি দেয়া হতো। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে গোটা নদীই পলিতে ভরে যাচ্ছে। অন্যদিকে আবাসন প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের মধ্যে কেউ কেউ নদ-নদীর কোন অবস্থা না বুঝেই বালু তুলছে। এ নিয়ে নানা ধরনের বিপত্তিকর খবর ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। বালুমহালের ইজারা নিয়ে অপ্রীতিকর খবরও কম প্রকাশিত হয়নি বা হচ্ছে না। বালু তোলাকে কেন্দ্র করে কেবল যে বালু নিয়েই সন্ত্রাস চলছে তা নয় বরং বালু উত্তোলন এবং বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র্র করে নদী দখলের মত ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে চলছে। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের ব্যাপারে ইতোপূর্বেও নানা ধরনের আলোচনা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে এতে পরিস্থতির কোন পরিবর্তন হয়নি। যে ধরনের সিন্ডিকেট এর সাথে জড়িত তারা প্রভাবশালী অথবা এর সাথে অবৈধ অর্থের লেনদেন থাকার কারণে এ সব বিষয়ে আজ পর্যন্ত হয়ত কোন সমাধানে পৌঁছা যায়নি। অথচ বালু উত্তোলনের বিষয়টিকে সুনির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় আনা গেলে তা কিছুটা হলেও ড্রেজিংয়ের কাজ দেয়। সাধারণত নদ-নদীগুলোর অবস্থা এরকম যে সব নদীর তলদেশের অবস্থা যেমনি এক নয়, তেমনি সব নদীর ভরাটের অবস্থাও এক নয়। সে বিবেচনায় কোথায় কোন নদীতে কোন জায়গা থেকে বালু তোলা যাবে বা সম্ভব সেটি মূলত সংশ্লিষ্টরা ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না। এ কারণেই এ নিয়ে সুষ্ঠু নীতিমালা অত্যন্ত অপরিহার্য। এমনও দেখা গেছে, এ ব্যাপারে কোন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিবেন সেই প্যাঁচেই এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা থেকে যায়। বর্তমান সময়ে অনেকদিন থেকেই নদীতীর সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। বালু উত্তোলনের বিষয়টির সাথে নদী তীর সংরক্ষণের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। সব মিলে এটা বলা যায় আপাতদৃষ্টিতে বালু উত্তোলন একটি সাধারণ বিষয় বলে মনে হলেও নদ-নদীর অস্তিত্ব রক্ষার বিবেচনায় এর গুরুত্ব অনেক বেশি।
নদ-নদী এবং এর সম্পদ সম্ভাবনার বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী যে ক’টি মন্ত্রণালয়কে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন তা সময়োপযোগী। এ নির্দেশ যদি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে না যায় এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তাহলে অবশ্যই সুফল দিতে বাধ্য। বর্তমানে নদ-নদীগুলোর যে অবস্থা তাতে এ ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র উদাসীন হবার কোন সুযোগ নেই। যে কোন উদাসীনতা বা অবহেলায় যদি নদ-নদীগুলো মরে যায় তার কড়া মাশুল দিতে হবে দেশের জনগণকেই। এমনিতেই পানির অভাবে জলবায়ু হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকিতে রয়েছে। নোনাপানি উপরে উঠে আসার কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে কৃষি। পেশাচ্যুত হচ্ছে নদীকেন্দ্রিক জীবনযাপন। মোট কথা হচ্ছে নদ-নদী রক্ষায় সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। সবদিক বিবেচনা করে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দিয়েছেন তা এবং নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকলে আন্তরিক হবেন- এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন