শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পরীক্ষার খাতা অবমূল্যায়ন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না

এম. এ. কাদের | প্রকাশের সময় : ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

খাতা অবমূল্যায়নে প্রতিবছর কত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হচ্ছে তার হিসাব নাই। অনেক জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে পরীক্ষার খাতা এমনকি সরকার নিয়ন্ত্রিত বোর্ড পরীক্ষার খাতাও (এসএসসি ও এইচএসসি) অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর চলতি বছরে সারাদেশে ১০টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে গত ১৪ নভেম্বর প্রায় ১৮ লক্ষ শিক্ষার্থী এসএসসি ও ১৪ লক্ষ শিক্ষার্থী ২ ডিসেম্বর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে। অনেক শিক্ষার্থী ভালো ফলাফলের জন্য রাতদিন পড়াশুনা করে ভালো পরীক্ষা দেওয়ার পরেও খাতা অবমূল্যায়নের ভয়ে উদ্বিগ্ন দিন কাটায়। শিক্ষার্থীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার খাতা বিভিন্ন কারণে অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। যেমন: অদক্ষ পরীক্ষক দ্বারা খাতা মূল্যায়ন করা, সঠিক নিরীক্ষণ না করা, পরীক্ষকের নিজ হাতে খাতা মূল্যায়ন না করা, স্বল্প সময়ে অধিক খাতা মূল্যায়ন করা, পরীক্ষার উত্তরপত্র ভালভাবে না পড়ে অনুমানের উপর নম্বর দেওয়া, পরীক্ষকের খাতা মূল্যায়নের সময় পারিবারিক বা অন্য কাজে মনোযোগ দেওয়া, খাতা মূল্যায়নের সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারি না করা, পরীক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকা, দুর্বল শিক্ষার্থীর সাথে ভালো শিক্ষার্থীর খাতা মিশে যাওয়া, পরীক্ষার মূল খাতার সাথে লুজ শিট সুতা দিয়ে সেলাই না করে পিন মারা, খাতা অবমূল্যায়নে শাস্তির বিধান না থাকা, শিক্ষার্থীর খাতা পুনঃমূল্যায়নে (কল) সহজ পন্থা না থাকা, পরীক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন না করা। একজন শিক্ষার্থী নার্সারী-প্লে ক্লাস থেকে শুরু করে ১২ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম, সাধনা করে এসএসসি পরীক্ষা দেয়, তার ১২ বছরের প্রতি মিনিটের সুফল নির্ভর করে পরীক্ষার ফলাফলের উপর। কিন্তু কোনো কারণে পরীক্ষকের অবহেলা, গাফিলতি বা সঠিক নিয়ম না মানার কারণে পরীক্ষার খাতা অবমূল্যায়ন হলে ঐ শিক্ষার্থীর যে ক্ষতি হয় সেটা কোনভাবেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কাজেই তাচ্ছিল্য বা যেনতেনভাবে খাতা মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। খাতা মূল্যায়নের জন্য কোনভাবেই অদক্ষ পরীক্ষককে সুযোগ দেওয়া উচিৎ নয়। কমপক্ষে ১০ বছর পরীক্ষার ঐ বিষয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকা বাঞ্ছনীয়।

দক্ষ পরীক্ষক দ্বারা খাতা মূল্যায়নের পর জবাবদিহিমূলক প্রধান পরীক্ষককে বর্তমানের শতকরা ১৩ ভাগের স্থলে শতকরা ২৫ ভাগ খাতা সঠিকভাবে নিরীক্ষণ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষক নিজ হাতে খাতা মূল্যায়ন না করে বাসার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, এমনকি প্রাইভেট পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারাও খাতা মূল্যায়ন করে থাকেন। এতে করে শিক্ষার্থীর খাতা একেবারেই মূল্যায়ন হয় না। শুধু অনুমান বা পাতা গুনে নম্বর দেওয়া হয়। এ রকমটি প্রমাণিত হলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। একটি খাতা মূল্যায়নের জন্য কমপক্ষে ৩০ মিনিট হিসাবে ৩ শত খাতা দেখার জন্য কমপক্ষে ১৫০ ঘণ্টা দরকার। অনেক ক্ষেত্রে সময়ের অভাবে তাড়াহুড়া বা অন্য অনভিজ্ঞদের দিয়ে খাতা মূল্যায়নের কারণে সঠিক মূল্যায়ন হয় না। কোনভাবেই একসঙ্গে একজন পরীক্ষককে ৩শ’ খাতা দেওয়া ঠিক নয়। আর যদি দিতেই হয় তাহলে অবশ্যই সময় বেশি দিতে হবে। অনেক পরীক্ষক উত্তরপত্র সঠিকভাবে না পড়ে অনুমানের উপর কলম দিয়ে দাগ দিয়ে পাতা উল্টিয়ে যান এবং মনগড়া নম্বর দেন। এতে করে একজন ভালো শিক্ষার্থীর অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। অবশ্যই প্রত্যেকটি লাইন পড়ে খাতা মূল্যায়ন করতে হবে। অনেক পরীক্ষক বাড়িতে খাতা মূল্যায়নের সময় পারিবারিক নানাবিধ সমস্যা, কথাবার্তা কাজকর্মের মধ্যে খাতা মূল্যায়ন করে থাকেন এক্ষেত্রেও খাতা অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। খাতা মূল্যায়নের সময় অবশ্যই নিরিবিলি পরিবেশ বেছে নিতে হবে।

খাতা মূল্যায়নের জন্য বোর্ড থেকে বণ্টনের পর পরীক্ষকদের সাথে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকায় পরীক্ষক দায়বদ্ধতা হারায়। অবশ্যই তদারকি ও যোগাযোগের মাধ্যমে বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ, বিষয়টি মাঝে মধ্যে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। শিক্ষার্থীর পরীক্ষার সিট প্ল্যানে অধিক দুর্বল শিক্ষার্থীর সাথে অনেক ভালো পরীক্ষার্থীর খাতা মিশে খাতা অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। পরীক্ষক পরপর কম নাম্বার পাওয়া খাতা মূল্যায়ন করতে করতে মন-মানসিকতা ঐভাবে তৈরি হয়ে যায়। এ কারণে কম নাম্বার পাওয়া খাতার সাথে মিশে অনেক ভালো শিক্ষার্থীর খাতাও সঠিকভাবে না পড়ার কারণে অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। পরীক্ষার মূল খাতার সাথে অতিরিক্ত লুজ শিট সুতা দিয়ে সেলাই না করে অনেক ক্ষেত্রে পিন মারা হয়। এতে করে পিনের মাথা অল্প আটকানোর কারণে অনেক খাতার চাপে লুজ শিট খুলে হারিয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। কোনভাবেই সেলাই ছাড়া পিন মারা সমীচীন হবে না।

শিক্ষার্থীর খাতা পুনঃমূল্যায়নের জন্য সহজ শর্তে পুনঃমূল্যায়নের ক্ষেত্রে শুধু নাম্বার যোগ দিয়ে নয়, প্রথম মূল্যায়িত নম্বর লিখে রেখে খাতায় দেওয়া প্রত্যেকটি নাম্বার ফ্লুইড দিয়ে মুছে পুনরায় ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দায়িত্বে মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে মূল্যায়ন করতে হবে। অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর পুনঃমূল্যায়নেও অভিযোগ থাকলে প্রয়োজনে দ্বিগুণ ফি জমা নিয়ে তার উপস্থিতিতে বুঝিয়ে দিতে হবে। বর্তমানে পরীক্ষককে একটি খাতা মূল্যায়নের জন্য মাত্র ২৫ টাকা দেওয়া হয়। এটা একেবারেই অপ্রতুল। অবশ্যই প্রতিটি খাতা মূল্যায়নের জন্য পারিশ্রমিক যুক্তিসংগতভাবে বাড়াতে হবে এবং অভিজ্ঞ পরীক্ষকদের অধিক মূল্যায়ন করতে হবে।

শিক্ষাই যেখানে জাতির মেরুদণ্ড, সেখানে অপরিকল্পিত, অনিয়মে খাতা মূল্যায়ন করার সুযোগ নাই। বর্তমানে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য একজন শিক্ষার্থী রাতদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৭/১৮ ঘণ্টা পড়েও সিলেবাস শেষ করতে পারছে না। এতবড় সিলেবাসে কোনো শিক্ষার্থী যদি ভালো ফলাফল করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে তার জীবন থেকে আনন্দ, বিশ্রাম, খেলাধুলা এমনকি পারিবারিক অনুষ্ঠানে বা সমাবেশে সে আগ্রহ হারাবে। শরীর সুস্থ রাখার জন্য প্রতিদিন যে ৭/৮ ঘণ্টা ঘুমানোর প্রয়োজনে তাও তার জীবন থেকে বিদায় নেবে। এই কারিকুলামে প্রতিটি সন্তানের সচেতন বাবা, মা তার বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন যা ভবিষ্যতের জন্য ভাবনার বিষয়। এরপরেও পরীক্ষকের অবহেলায়, অনিয়মে উত্তরপত্র যদি অবমূল্যায়ন হয় তাহলে ঐ শিক্ষার্থীর ও অভিভাবকদের সান্ত্বনা পাওয়ার আর কিছুই থাকে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন