বছরের এই সময়ে অনেকে জন্ডিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। জন্ডিস হচ্ছে যকৃতের প্রদাহ বা হেপাটাইটিস। এটি লিভারের রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ মাত্র। চোখ, হাত, পা, শরীর, প্রস্রাব হলুদ হলে বা কোন কারন ছাড়াই অরুচিতে ভুগলেই রুগীরা ডাক্তারের শরনাপন্ন হচ্ছেন।
জন্ডিসের কারণ:
জন্ডিসের কারণ গুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। সংক্রমনের কারনে ও সংক্রমন ছাড়া অন্যান্য কারনে। ভাইরাসজনিত কারণগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই এভাবে নাম করণ করা হয়েছে। আবার এগুলি ছাড়াও অন্য কিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস বা পরজীবি সংক্রমনেও কিছু হেপাটাইটিস হয়। আর ভাইরাসের বাহিরের কারণগুলো হতে পারে অ্যালকোহল বা ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিত্তনালীতে পাথরজনিত কারণে হতে পারে অথবা টিউমার বা লিভার ক্যান্সারের কারণেও হতে পারে।
আমাদের দেশে সাধারণত হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস ই এই দুটি ভাইরাস বাহিরের অপরিচ্ছন্ন অথবা বাসি খাবার এবং অবিশুদ্ধ পানির মাধ্যমে ছড়ায়। আর হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি রক্ত বা ব্যবহৃত ইঞ্জেকশন এর সূচ, ব্লেড, ক্ষুর, ডাক্তারের অপারেশনের যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ছড়ায়।
জন্ডিসের লক্ষণ:
লিভারের যেকোনো জটিলতার কারণে চোখ হলুদ হওয়া, প্রস্রাব হলুদ হওয়া, মুখগহ্বর হলুদ হওয়া, শরীরের চামড়া হলুদ হয়ে কখনও কখনও চুলকানি দেখা দেয়। প্রথমে যে লক্ষণ দেখা যায় যথাক্রমে খাবারে অরুচি, অতিরিক্ত দূর্বলতা এরপরে তার চোখ এবং প্রস্রাব হলুদ হওয়া। একই সাথে অনেকের পেটে ব্যথা বা বমি বা বমি বমি ভাব হতে পারে। এটাকে আমরা জন্ডিসের লক্ষণ হিসেবেও বলে থাকি। আর এই জন্ডিস হওয়া মানে আমরা ধরে নেই শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংগ যকৃত বা লিভার ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত হয়েছে।
আক্রান্ত রোগির খাবার কেমন হবে?
খাবারের ব্যাপারে তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে ভাইরাল হেপাটাইটিসে যকৃতের কার্যকারিতা কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়। তাই যকৃৎ ও পিত্তথলির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয় এমন কিছু খাবার এড়িয়ে চলাই উচিত। যেমন: মশলাযুক্ত বা চর্বিজাতীয় খাবার (ঘি, মাখন, যেকোনো ভাজা খাবার বা ফাস্টফুড, খাসির মাংস ইত্যাদি) এইসময় অবশ্যই পরিহার করে চলতে হবে। জন্ডিসের রোগীদের ক্যালরির উৎস হিসেবে তাই সহজে হজমযোগ্য সরল শর্করা, যেমন: বাসায় তৈরী শরবত, জাউভাত, সুজি, রুটি, ডাবের পানি ইত্যাদি বেশি খাওয়া উচিত।
বিশ্রাম কেমন হবে?
পূর্ণ বিশ্রাম মানে এই সময়ে ভারী কোনো কাজ বা পরিশ্রমের কোনো কাজ না করা। কারণ, ভাইরাল হেপাটাইটিস লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ফলে পূর্ণ বিশ্রাম না নিলে বা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের ফলে জন্ডিসের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জটিল আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি রুগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
চিকিৎসা:
বাড়িতে নিজে নিজে চিকিৎসা করা বা কবিরাজের দাওয়াই নেয়া, টনিক খাওয়া, ঝারফুক করা, মালা পরা, হাত ধোয়া ইত্যাদি ইত্যাদি ক্ষতিকর ও অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা না নিয়ে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এগুলোর কোনটাই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারনেই এটি একসময় দূর্বল হয়ে যায়। ৭ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে রক্তে এসজিপিটি ও বিলিরুবিনের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে গেলে জন্ডিস এমনিতেই সেরে যায়। ভাইরাল হেপাটাইটিস বা জন্ডিসের সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই; চিকিৎসা হবে উপসর্গ অনুযায়ী। এই সময়ে শরীরের ও যকৃতের পর্যাপ্ত বিশ্রামই হবে মূল চিকিৎসা। এ সময় ব্যথার ওষুধ যেমন: প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, ঘুমের ওষুধসহ অন্য কোনো অপ্রয়োজনীয় ও বিশেষ করে প্রচলিত কবিরাজি ওষুধ খাওয়া একদমই উচিত নয়। এগুলোর কোন কোনটা যকৃতের কাজকে বাড়িয়ে দিয়ে তাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। এককথায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধই বাস্তবে সেবন করা ঠিক না। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার ঝুঁকিটাই বেশি থাকে।
সাবধানতা ও প্রতিরোধ:
রোগীকে বাইরের খাবার সব সময় পরিহার করতে হবে। বিশেষ করে খুব সাবধান থাকতে হবে পানির ক্ষেত্রে। জন্ডিস থাক বা না থাক, না ফুটিয়ে পানি পান করা যাবে না। বিভিন্ন রকমের ফিল্টার, পানি শোধনের ডিভাইস আজকাল অনেক জনপ্রিয় হয়েছে, তবে এগুলোর কোনটাই পানিকে ভাল মানের বিশুদ্ধ করতে পারে না যতটা পারে ভালভাবে ফুটানো পানি। আর বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে বাহিরের দোকানের ফুচকা, আচার, চটপটি, বোরহানির ব্যাপারে। টিকা আবিস্কার হওয়ার পর উন্নত বিশ্বে হেপাটাইটিস বি সংক্রমন অনেক কমে এসেছে। তাই আমরাও হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস এ থেকে বাঁচতে পারি সময়মত টিকা নিয়ে।
ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী;
রেজিস্ট্রার, সিওমেক হাসপাতাল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন