মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) শিল্পের বিকাশ জরুরি। দেশের অর্থ নৈতিক উন্নয়ন ক্রমাগত ভাবে বৃদ্ধি পেলেও নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান। সম্পদের সুষম বণ্টন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না হলে এবং সচ্ছতা ও জবাব দিহির ঘাটতি অর্থ নীতিতে বৈষম্য সৃষ্টি করে। বড় বড় শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অথচ, এইখাতটি অনেকটা অবহেলিত। এর বিকাশ ঘটানো গেলে কর্মসংস্থানের বিরাট ক্ষেত্র তৈরিসহ দারিদ্র দূরীকরণে অনন্য অবাদান রাখতে পারে। অভ্যন্তরীণ বাজারে দৈনদিন প্রয়োজনের পণ্য সামগ্রীর সরবরাহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত থেকে এসে থাকে। এখাতের উদ্যোক্তাদের পুঁজি কম, আয়ও কম। প্রয়োজনীয় পুঁজি, অর্থায়ন ও বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ পেলে জাতীয় অর্থনীতিতে এসএমই খাত আরো ভালো ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

বর্তমানে এসএমই বলতে মূলত কটেজ, মাইক্রো, স্মল এন্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ অর্থাৎ একে সিএম এসএমই বলা হয়। কটেজ ও মাইক্রো শিল্পখাতে স্বল্প পুঁজিতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অবদান এসএমই খাতের। কিন্তু আমাদের দেশের এসএমই খাত বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ইউরোপীয় দেশগুলোর জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৫৫ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর অবদান ৪৫ শতাংশ। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপিতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অবদান রাখছে এসএমই খাত। ২০১৩ সালের বাংলাদেশের শিল্পনীতি-২০১৬ সালের সংজ্ঞা অনুয়ায়ী ১৬ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত কর্মীর প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালে শিল্পখাতে জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৪৬ হাজার ২৯১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে, যার ৯৩ ভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র, কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান (বিসিক) ১৯৫৭ সাল থেকেই এখাতে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৪ সাল থেকে এসএমই খাতে পুনঃঅর্থায়নের কর্মসূচী হাতে নেয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ‘এসএমই এন্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপাটমেন্ট’ নামে একটি বিভাগ খোলা হয়। এই খাতের জন্য ২০১০ সালে বিস্তৃত এসএমই ঋণনীতি মালা প্রণয়ন করা হয়। সাথে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি এসএমই নীতিমালার আওতায় এনে এখাতে বিনিয়োগ প্রদানে উদ্বুদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, পিকেএসএফ এবং এসএমই ফাউন্ডেশন মূলত এসএমই খাতে ঋণ বিতরণের কাজ করছে। এখাতে বিসিকের ভূমিকা তো আছেই। কটেজ মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএম এসএমই) উদ্যোক্তার মধ্যে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে এসএমই ফাউন্ডেশন। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য থেকে জানা যায়, বিতরণকৃত ঋণের ৬৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ পুরুষ উদ্যোক্তা এবং ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বিতরণকৃত ঋণের ৮০ দশমিক ২৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ঢাকার বাইরের। সম্প্রতি এসএমই ফাউন্ডেশন ১৯টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি সই করে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রণোদনার ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় অর্থ বিভাগ। দেশের পল্লী ও প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের কাছে প্রণোদনার অর্থ পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হয়েও তা যথেষ্ঠ নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সার্বিকভাবে অর্থয়ানে মূল স্রোত ধারায় এসএমই খাত আসতে পারেনি। এসএমই বিনিয়োগ উন্নয়নের মূলধারায়ও আসতে পারেনি। লক্ষ্য করা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে কভিড-১৯ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে প্যাকেজ দেওয়া হয় তাতে ছোট-বড় সব সেক্টর অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, রপ্তানিখাত, আর এমজি এক্সপোর্ট সেক্টর ও বৃহৎ শিল্পখাতে দ্রুত প্যাকেজের অর্থ বিতরণ হলেও এসএমই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কাক্সিক্ষত হারে অর্থ বিতরণ করতে সক্ষম হয়নি। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াও ঋণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ঘাটতির কথা বলা হয়। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বিতীয় দফায় আর ও ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। ১ এপ্রিল ২০২১ থেকে যা শুরু হয়। দ্বিতীয় দফার মেয়াদ ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনার প্যাকেজে বলা হয় বরাদ্দের ৭০ শতাংশ দিতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের, ৩০ শতাংশ দিতে বলা মাঝারি উদ্যোক্তাদের। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ৭০ শতাংশের মধ্যে ৬৫ শতাংশ সেবা ও উৎপাদন খাতে এবং ৩৫ শতাংশ ট্রেডিং ও ব্যবসা খাতে দেওয়ার জন্য বলা হয়। প্যাকেজে বলা হয়, ৮ শতাংশ দিতে হবে নারী উদ্যোক্তাদের। গবেষণায় দেখা গেছে করোনার সিএম এসএমই খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এসএমই খাতে সামগ্রিক আয় হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ। উৎপাদিত পণ্য অবিক্রিত থেকেছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।

এসএমই খাতের বড় সমস্যা হলো অর্থায়ন। উদ্যোক্তারা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে খুব কমই ঋণ পান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এনজিও মাইক্রে ফাইন্যান্স ইনস্টিটিশনের উপর নির্ভর করতে হয়, যেখানে অতি উচ্চ হারে সুদ দিতে হয়। ব্যাংকগুলো এখাতে ঋণ দিতে চায় না, ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। অল্প অল্প করে অধিক মানুষকে ঋণ দিতে হয়, এতে সুপার ভিশনে অনেক সময় ব্যয় হয়Ñ এসব অজুহাত দেখিয়ে ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্র বিনিয়োগে কম যেতে চায়। আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি, আধুনিক কৌশল ও সৃজনশীল উপায় চিন্তা করলে এসব অজুহাত টেকে না। তাই সহজে ঋণ প্রাপ্তি ও এখাতের পরিধি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রয়োজনে এসএমই উদ্যোক্তাদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার করা যেতে পারে। এসএমই খাতের সাথে বিশাল জনগোষ্ঠি জড়িত। দ্রুত বিকাশমান একটি খাত, আগের চেয়ে বেশি প্রযুক্তিনির্ভর আয়বর্ধক খাত ও শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষতদের নিয়ে এইখাত। কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় সুযোগ ও ক্ষেত্র হচ্ছে এসএমই খাত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড এমপ্লমেন্ট রিসার্চের গবেষণায় বলা হয়, উচ্চ শিক্ষিত, শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার ১৬.৪ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে শ্রমশক্তি বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। তাছাড়া আমাদের শিল্প কারখানা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোক পাচ্ছে না। বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক) নামের সরকারি সংস্থাটির গাফলতির কারণে দেশের শিল্পায়নের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশ জনসংখ্যার বোনাসকাল (ডেমো গ্রাফিক ডিভিডেন্ড) ভোগ করছে। দেশে এখন ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ। বিশাল এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে এসএমই শিল্পখাতের বিকাশ ও প্রসারের বিকল্প নেই। তাছাড়া দারিদ্র্য বিমোচনের বড় হাতিয়ার হলো এসএমই খাত। টেকসই উন্নয়নে পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় এখাতের যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এসএমই শিল্প খাতের বিকাশ ও এখাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যথাযথ নীতি-কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। এসএমই পণ্যের দেশীয় বাজারে চাহিদা সৃষ্টির পাশাপাশি রপ্তানি ক্ষেত্রেও সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। বেসকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি মানে বড় বড় শিল্পে ঋণ বাড়াতে হবে, এমন চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহজীকরণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন বা বেসরকারি সংস্থাসমূহকে ব্যবসায়ীদের দোরগোড়ায় সব ধরনের তথ্য পৌঁছাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। উদ্যোক্তাদের কোন ব্যবসায়ে কী ঝুঁকি বা সম্ভাবনা কেমন তা জানানোর ব্যবস্থা করা উচিত। বাংলাদেশ বড় শিল্পের সংগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসায়ী সংযোগ গড়ে উঠেনি। বড় বড় শিল্পের সহায়ক হিসাবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে গড়ে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের যোগসূত্র তৈরি করা উচিত। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র দূরীকরণের হাতিয়ার হিসাবে এসএমইর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এখাতে বিনিয়োগ করলে ও নিয়মিত তদারকি করলে দেশের অর্থনীতি এক দিকে যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি ঋণ আদায়ের হারও বৃদ্ধি পাবে। কর্মসংস্থানেরও বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হবে।
লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন