মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক বর্বরতার তদন্ত দাবী করেছে জাতিসংঘ। দশকের পর দশক ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হলেও এবারের চিত্র বিশ্বসম্প্রদায়কে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী হতাশ করেছে। কারণ, প্রায় চার দশকের সামরিক জান্তার শাসন পেরিয়ে গত বছর মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়েছে। গণতন্ত্রের দাবীতে সুদীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও কারাভোগের পর অং-সান সুচি এখন মিয়ানমারের নতুন পথযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিশ্ব শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নেত্রীর নেতৃত্বে মিয়ানমারে পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার সমুন্নত হবে, এটাই ছিল সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু সুচি’র মিয়ানমারেও রোহিঙ্গা নাগরিকদের একই ধরনের সহিংসতা ও গণহত্যার শিকার হওয়ার ঘটনা মানবাধিকার ও শান্তিকামী বিশ্বসম্প্রদায়কে হতাশ করেছে। জাতিসংঘের বিশেষ উদ্যোগে গতমাসের শুরু থেকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন কাজ শুরু করেছিল। তবে কোফি আনানসহ কমিটির সদস্যরা মিয়ানমারে কাজ শুরু করার আগে থেকেই বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এই কমিটির কাজের বিরোধিতায় মাঠে নামে। কোফি আনানসহ কমিটির সদস্যরা তাদের বিদ্বেষ ও বৈরিতার শিকার হয়েছেন। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের আহ্বান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপে এনএলডি সরকার তথা রাইখাইন রাজ্য বিষয়ক ৯ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিশন গঠনে বাধ্য হলেও এই কমিশনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টি এখন স্পষ্টতই প্রশ্নবিদ্ধ।
ইতিপূর্বে রোহিঙ্গাদের উপর যে গণহত্যা ও নারকীয় বর্বরতা সংঘটিত হয়েছে, নতুন সরকার সে সব ঘটনার বিচারিক সমাধানের পাশাপাশি সেখানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করবে, এটাই ছিল অং-সান সুচির কাছে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রত্যাশা। সে প্রত্যাশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে সেখানে আবারো রোহিঙ্গাদের জাতিগত বিনাশ ও উচ্ছেদের পথ বেছে নিয়েছে সরকারী বাহিনী। গত সপ্তাহে সীমান্তরক্ষিদের উপর কথিত হামলার জের ধরে সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি গ্রামে ঢুকে গ্রামের বাসিন্দাদের তাৎক্ষণিকভাবে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেয়। দৃশ্যমান কোন কারণ বা নোটিশ ছাড়াই দুই হাজারের বেশী রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করেছে সেনারা। প্রাণভয়ে সহায়-সম্বল সবকিছু ফেলে বাড়ী থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে ও ধানক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছে শত শত রোহিঙ্গা মুসলমান। মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী ও বৌদ্ধ রাখাইনদের জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে রাখাইন রাজ্যের লাখ লাখ রোহিঙ্গা দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। সবচেয়ে কাছের সীমান্তবর্তী দেশ এবং মুসলমান হওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা বার বার মরিয়া হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য ছুটে এসেছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা নানা ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাও তৈরী করছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্ব এবং মানবিক কারণে রাখাইন রাজ্যের জাতিগত সমস্যা এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয় রয়েছে।
ভারতের পর মিয়ানমার বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশি রাষ্ট্র। রোহিঙ্গা শরনার্থী ইস্যু সীমান্ত নিরাপত্তাসহ দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং উপআঞ্চলিক যোগাযোগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। মিয়ানমার সীমান্তে কথিত সাম্প্রতিক হামলায় কিছু সংখ্যক সীমান্তরক্ষী নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের সাথে সীমান্তরক্ষী পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে টালবাহানার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তবে মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী এবং উগ্রবাদি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সহিংসতার শিকার হওয়া ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ইস্যুটি এখন একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে গণ্য। এ ইস্যুর স্থায়ী সমাধানের প্রশ্নে জাতিসংঘের পাশাপাশি বাংলাদেশসহ প্রতিবেশি ও ভুক্তভোগি দেশগুলোকে আরো জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষত: রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রি অং সান সুচি’র আরো স্বচ্ছ ও দৃঢ় ভূমিকাই প্রত্যাশিত। সুচি’র দল এনএলডি মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাজনৈতিক কারণে কোন সহিংস সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির সাথে আপস করে চলা যদি অং সান সুচি’র বর্তমান নীতি হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেত্রি হিসেবে সুচি এবং তার দল ইমেজ ও গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। যেখানে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গা নাগরিকদের উপর সহিংসতা ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে, সেখানে সীমান্ত চৌকিতে অতর্কিত হামলায় কয়েকজন রক্ষী হত্যার ঘটনাকে ইস্যু করে রোহিঙ্গাদের উপর নতুন করে সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও উচ্ছেদ অভিযান কাম্য নয়। রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রীর কাছে আমরা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিমূলক ভূমিকা আশা করি না। রাজনৈতিক কারণে জাতিগত বিদ্বেষী ও উগ্রবাদী শক্তির কাছে আপস করার কোন সুযোগ নেই। জাতিসংঘের আহ্বানের প্রতি সাড়া দিয়ে তিনি রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর উচ্ছেদ অভিযানের তদন্ত করে, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেবেন, এটাই সকলের প্রত্যাশা। সেই সাথে ‘রাখাইন রাজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কমিশন’কে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিক প্রয়াসের সঙ্গে সরকারের সদিচ্ছা যুক্ত হলে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন