শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ | প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

দেখতে দেখতে হাঁটি হাঁটি পা পা করে অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে আমরা অতিক্রম করেছি ৫০টি বছর। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি বাংলদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ, যেখানে রয়েছে এক কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। এটি সম্ভব হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। তার সাহসী এবং গতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঠামোগত রূপান্তর এবং উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রæত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। সমুদ্র বিজয় এবং মহাকাশ বিজয় পুরো জাতির সামনে দৃশ্যমান। কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে, যা মানুষের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে এবং এর সুযোগ-সুবিধা মানুষ পাচ্ছে। এই সুযোগ-সুবিধার কারণটা মানুষ সঠিকভাবে জানেও না, জানতে চেষ্টাও করে না। তেমনি একটা ক্ষেত্র হলো স্বাস্থ্য খাত। মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, শিশু মৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে। সীমাবদ্ধ সম্পদ ও বিপুল জনগোষ্ঠী নিয়ে এ অর্জন যে প্রশংসনীয়, তা জাতীয়সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবাই স্বীকার করেন। স্বাস্থ্যখাতের এই অর্জনের জন্য ৩টি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছে স্বাস্থ্যখাত। এর মধ্যে এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির প্রনয়ন এই সরকারের এক উল্লেখযোগ্য অর্জন। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পের উন্নয়ন গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা যায়। আজ নিজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪৫টি দেশে বাংলাদেশের ঔষধ রপ্তানি হচ্ছে।

বিশাল এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ সহজ কাজ নয়। অনেকেই বিদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার তুলনা করেন। দেশের জনসংখ্যা এবং আর্থিক সক্ষমতা তারা মাথায় রাখেন না। ডাক্তার-রোগী, ডাক্তার-সেবিকার আনুপাতিক হারের বিষয়টি চিন্তা করেন না। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যখাতে অন্যতম পদক্ষেপ হলো কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে এই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পটি শেখ হাসিনা সরকার গ্রহণ করেন এবং প্রায় দশ হাজার ক্লিনিক স্থাপন করেছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো জনবান্ধব মানবিক উদ্যোগকে শুধু রাজনৈতিক কারণে বন্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার ৫ শত কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন অনলাইন জরিপ এবং বিবিএসের তথ্য অনুসারে, কমিউনিটি ক্লিনিকের ৯০ শতাংশের বেশি গ্রাহকা তাদের পরিষেবা ও সুবিধার ক্ষেত্রে সন্তষ্টি প্রকাশ করেছেন। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সুযোগ সুবিধা। স্থাপন করা হয়েছে হৃদরোগ, কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, নিউরো, চক্ষু, বার্ন, নাক-কান-গলাসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। অব্যাহত নার্সের চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট। প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করার কাজ চলছে। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ বিশে^ অন্যতম আদর্শ দেশ হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতাল গুলোতেও শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনের উন্নয়ন স্বাস্থ্যখাতকে উন্নত করছে। সব হাসপাতালে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ই-গভর্ন্যান্স ও ই-টেন্ডাটিং চালু করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অনলাইন সেবা কার্যক্রম চালু করতে ‘ভিশন সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃত্যুরোধে এখন পর্যন্ত সফল্যের পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক দেশ টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে না পারলেও, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিনামূল্যে প্রায় এগার কোটি মানুষের টিকাদান স¤পন্ন হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিক নির্দেশনায় দেশে করোনা ভ্যাক্সিন উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হবে। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট : টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ারস অন’ শীর্ষক বইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্যসেবাখাত বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসা চাহিদা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকের ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভ‚তপূর্ব অর্জন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে বহুদূর।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিনত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে, যা মোটেও সহজ কাজ নয়। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সম্ভব হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে ১২ জানুয়ারি থেকে তাঁরই নেতৃত্বে ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের পুনর্গঠনের নবযাত্রা। তখন আমাদের মাথাপিছু আয় ছিলো মাত্র ১০০-১৫০ মার্কিন ডলার। জিডিপি ছিল শূন্যের চেয়েও কম অর্থাৎ ঋণাত্বক। উন্নয়নের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না। সবকিছুই ছিলো বিধ্বস্ত। শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের পথচলা। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ২৫৫৪ ডলার। অর্থাৎ মানদন্ডের প্রায় ১ দশমিক ৯ গুণ। মানবসম্পদ সূচকে নির্ধারিত মানদন্ড ৬৬-এর বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫ দশমিক ৪। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে উত্তরণের জন্য মানদন্ড নির্ধারিত ছিল ৩২ বা তার কম। ওই সময় এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৭। বলার অপেক্ষা রাখে না, সবকটি খাতেই সর্বনিম্ন সূচক থেকে অনেক উপরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞ হিসাবে সরকারের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনার বিভিন্ন দিক আর তার কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নতির চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করিছি। স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রভ‚ত কাজ করেছে। সরকার সকল জনগণ বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ পরিবার পরিকল্পনার বর্তমান অবস্থা বিশেষ করে নারী, শিশু ও প্রবীণদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং শারীরিক, সামাজিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার ক্ষেত্রে টেকসই উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত (এইচএনপি) এ সেক্টরের মূল লক্ষ্য। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি, জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নীতি এবং জাতীয় জনসংখ্যা নীতি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) সমূহ অর্জনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যে কিছু সূচক যেমন: শিশু মৃত্যু হার হ্রাস, শিশু ও মায়েদের টিকা দেয়া, ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতি দূরীকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসাধারণ অর্জন সাধিত হয়েছে। অন্যান্য সুচকসমূহে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকায় সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমন্বিত প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এমজিডি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিসহ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রফতানীমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রফতানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি ও পরিশ্রমের ফসল। এছাড়া চলমান রয়েছে, পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ। আমরা দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যা হবে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণের একমাত্র পথ।

লেখকঃ উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন