ধূমপান এবং তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, (২০০৫) এর বিভিন্ন দুর্বল দিকসমূহ ও তামাক কোম্পানির অনৈতিক বিক্রয়কেন্দ্রে পন্য প্রদর্শন ও ঢাকা শহরের রেস্তোঁরায় ধুমপানের জন্য নির্ধারিত স্থানের জন্য লোভনীয় প্রণোদনা দিয়ে থাকে। সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংগঠন ভয়েসেস ফর ইন্টারেক্টিভ চয়েস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট (ভয়েস) তামাক কোম্পানির উল্লেখিত অনৈতিক কূটকৌশল ও ধূমপান এবং তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে দুইটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে।
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে) এর সহযোগিতয় সিরডাপ মিলনায়তনে মত বিনিময় অনুষ্ঠানে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহল হক এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব অসীম কুমার উকিল এমপি; হোসেন আলী খোন্দকার, অতিরিক্ত সচিব এবং সমন্বয়কারী, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল; মোস্তাফিজুর রহমান, লিড পলিসি অ্যাডভাইজার, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস; প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব করেন মনজুরুল আহসান বুলবুল, এডিটর ইন চিফ, টিভি টুডে এবং অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ।
গবেষণায় পাওয়া যায় যে, তামাক কোম্পানিগুলো তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে তামাক বিক্রয়কে উৎসাহিত করে। তারা বিভিন্ন কৌশল যেমন পণ্য বিক্রয়ের উপর লক্ষ্যমাত্রা প্রদান, সেরা বিক্রেতাদের নাম তামাক কোম্পানির বিশেষ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, আকর্ষণীয় উপহার সামগ্রী প্রদান এবং প্রয়োজনীয় গৃহস্থালী সরঞ্জাম যেমন বিছানা, আলমিরা, প্রেসার কুকার, রাইস কুকার, ব্লেন্ডার ইত্যাদি এবং বিলাস সামগ্রী সোনার কয়েন, এলইডি টিভি, এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রিজ এবং দামী গিফট ভাউচার ইত্যাদি দিয়ে থাকে। এছাড়াও বিএটি এবং জেটিআই উভয়ই ডিলার, পাইকার এবং খুচরা বিক্রেতাদের উৎসাহ প্রদানের জন্য উদযাপনমূলক ডিনার এবং দেশে-বিদেশে বিনামূল্যে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে থাকে।
জরিপকৃত সমস্ত রেস্তোরাঁয় "আলোকিত রঙিন সজ্জিত বাক্স" (যার ভেতর সিগারেটের খালি প্যাকেট) বিজ্ঞাপনের উপকরণ হিসাবে প্রদর্শিত হতে দেখা গিয়েছে। যার সবগুলোতেই ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (BATB) এর সাইন/লোগো পাওয়া গিয়েছে। শতকরা ৭৩ ভাগ রেস্তোরাঁয় ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকায়, শতকরা ২৭ ভাগ রেস্তোরাঁর প্রবেশ/প্রস্থান পথে এবং রেস্তোরাঁর খাবার পরিবেশন টেবিলের কাছে বিজ্ঞাপন সামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে। এই বিজ্ঞাপন সামগ্রী প্রদর্শনের জন্য তামাক কোম্পানি রেস্তোরার মালিকদের এককালীন নগদ আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে। রেস্তোরাঁর অবস্থান অনুযায়ী যার গড় পরিমাণ আট লক্ষ টাকা, সর্বোচ্চ পনেরো লক্ষ টাকা এবং সর্বনিম্ন চার লক্ষ টাকা এবং এই নগদ সুবিধা ব্যাংক চেক এবং ব্যাংক ট্রান্সফার এই দুই মাধ্যমে দেয়া হয়। এই সুবিধা নেয়ার সময় ৬০% রেস্তোরাঁ লিখিত চুক্তি করেছে এবং ৪০% মৌখিক চুক্তি করেছে।
গবেষণায় আরো জানা যায়, রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের উপহার পেয়ে থাকে। যেমন: টি-শার্ট, লাইটার, অ্যাশ ট্রে, রান্নার জিনিস, কফি মগ, তামাকজাত দ্রব্য, কম দামে তামাকজাত দ্রব্য, প্লেট/গ্লাস, কোভিড প্রতিরক্ষামূলক সামগ্রী, নতুন সিগারেট ব্র্যান্ডের বিনামূল্যে নমুনা ইত্যাদি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশের নিশ্চিত করতে, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে আরো জোরদার করে সকল বিক্রয় কেন্দ্রে তামাকপণ্যের প্রদর্শন, বিজ্ঞাপন ও প্রচার নিষিদ্ধ করা। অধূমপায়ীদের বিশেষ করে শিশু ও নারীদের পরোক্ষ ধুমপান হতে বাঁচানোর জন্যে সব ধরনের পাবলিক প্লেস থেকে পৃথক ধুমপান এলাকার রাখার বিধান বাতিল করার জোর দাবী জানানো হয়।
সাবেক স্বাস্থ্যমস্ত্রী ডা: আ. ফ. ম. রুহুল হক বলেন, ধূমপানের বিরুদ্ধে মানুষ যথেষ্ট সচেতন তবে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠি ব্যবসায়িক স্বার্থে যদি আইন লঙ্ঘণ করে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কঠোর হতে হবে। তিনি বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার এবং বিক্রির স্থানে পণ্য প্রদর্শন ও বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার কঠোর বিধান অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান।
জনাব অসীম কুমার উকিল এমপি বলেন, পাবলিক পরিবহনে ধুমপানের ব্যাবস্থা আগের থেকে কমেছে। এর থেকে বুঝা যাচ্ছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এর পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা ব্যাবহার করে রেস্তোরাঁয় ধুমপানের নির্ধারিত স্থান রাখার বিধান বাতিল করতে হবে। যাতে অধুমপায়ী বিশেষ করে, নারী এবং শিশুরা পরোক্ষ ধুমপান থেকে রক্ষা পায়।
হোসেন আলী খোন্দকার, অতিরিক্ত সচিব এবং সমন্বয়কারী, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল আশ্বস্ত করেছেন যে, আমরা ইতিমধ্যে তামাক আইন শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছি এবং তিনি এ বিষয়ে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমর্থন এবং সমন্বয় প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন।
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে)এর লিড পলিসি অ্যাডভাইজার মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলোর অধিক মাত্রার মুনাফার আকাঙ্খা প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের পথে বড় বাঁধা। তিনি আরো বলেন, এই গবেষণা-ভিত্তিক প্রমাণাদি আমাদের বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করতে এবং সংসদে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে সাহায্য করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন