বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলে গেল দুই দেশের সমঝোতা স্মারকে। আশা করা হচ্ছে, এ সমঝোতা স্মারকের বদৌলতে নতুন বছরের প্রথম মাসেই দেশটিতে কাজ নিয়ে যেতে পারবে বাংলাদেশি কর্মজীবীরা। সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ নিয়োগকর্তা বহন করবে। সে দেশের রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি নিয়োগ, কর্মীদের মালয়েশিয়ায় আনয়ন, আবাসন, কর্মে নিয়োগ এবং কর্মীর নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর খরচ নিয়োগকর্তা বহন করবে। মালয়েশিয়ায় আসার পর বাংলাদেশি কর্মীর ইমিগ্রেশন ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ইনস্যুরেন্স, করোনা পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইনসহ সব খরচ মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বহন করবে। নিয়োগকর্তা কর্মীর মানসম্মত আবাসন, বীমা, চিকিৎসা ও কল্যাণ নিশ্চিত করবে। এর ফলে বাংলাদেশি কর্মীদের অভিবাসন খরচ হ্রাস পাবে। প্রত্যেক কর্মীকে মালয়েশিয়ার এমপ্লয়িজ সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় কর্মকালীন দুর্ঘটনা বা কাজের কারণে শারীরিক সমস্যা হলে চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম বা এসওপি নির্ধারণ করা হবে। তারপরই শুরু হবে কর্মী নিয়োগের পালা। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য উন্মোচন হওয়া নিঃসন্দেহে একটি সুসংবাদ। এ শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধের আগে এটি ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি শুরু হওয়ার ফলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হবে ইতিবাচক সুযোগ।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নতুন করে উন্মুক্ত হওয়ার খবর উৎসাহব্যঞ্জক। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত জনশক্তি রপ্তানি। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখনো জনশক্তি রপ্তানির প্রধান টার্গেট। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানির বাজার দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলতে সরকার নানাভাবে তৎপরতা চালিয়েছে। সরকারিভাবে (জিটুজি পদ্ধতি) কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ১০টি প্রতিষ্ঠান (সিন্ডিকেট) দুর্নীতি করায় গত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী নিয়োগ স্থগিত হয়। গত আড়াই বছরে শ্রমবাজার চালুর বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে কমপক্ষে পাঁচবার ইতিবাচক ঘোষণা এলেও ওই সিন্ডিকেটের জন্যই তা শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। দুর্নীতির অভিযোগে জিটুজি প্লাস বাতিল করে দেয় মালয়েশীয় সরকার। জিটুজি প্লাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যেতে প্রথমে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। পরে তা ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা করা হয়। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে প্রায় সব কর্মী মালয়েশিয়া যেতে তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে দু’দেশের এজেন্টরা পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয় বলে মালয়েশিয়া সরকারের অভিযোগ। জিটুজি প্লাসে কর্মী পাঠানোর কাজ পায় ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি। এ অবস্থায় মালয়েশিয়া কর্মী নিয়োগের বিশেষ পদ্ধতি থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়। এর ফলে দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে। একই সঙ্গে সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি অনিয়মিত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নানারকম হয়রানি শুরু হয়, যা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। এবারের সমঝোতা স্মারকে বেশকিছু বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিটুজি প্লাস পদ্ধতি উল্লেখ থাকছে না, যুক্ত হচ্ছে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সি, থাকছে কর্মীদের বাধ্যতামূলক বিমা, কর্মীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা ও খরচ বহন করবে নিয়োগদাতা, চুক্তি মেয়াদে কর্মীদের দায়িত্ব নিতে হবে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সিকেও। মালয়েশিয়ায় আমাদের বিপুল সংখ্যক কর্মী কাজ করছে। মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে অবশ্যই আগের ভুলত্রুটি মোকাবিলা করে এই শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাটাই এখন বড় কর্তব্য।
দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা প্রথাগত উৎপাদন ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তা নাহলে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী লাখ লাখ যুবক কর্মহীন থাকার পরও গার্মেন্ট সেক্টরে প্রতিবেশী দেশ থেকে হাজার হাজার শ্রমিক এনে চাহিদা পূরণ করতে হতো না। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের খামখেয়ালি এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারি ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনার অভাবও অনেকাংশে দায়ী। একজন অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও বেতন-ভাতা অনেক বেশি। দেশের লাখ লাখ অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে গিয়ে যে পরিমাণ রেমিটেন্স আয় করছে, দেশের গার্মেন্ট সেক্টরে তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক কাজ করে অনেক বেশি রেমিটেন্স নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার কারণে একদিকে যেমন বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্য রেমিটেন্স থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি, অন্যদিকে দেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে অর্জিত রেমিটেন্সও দেশে রাখতে পারছি না। দক্ষ জনশক্তির অভাব আমাদের অর্থনৈতিক শক্তিকে ভেতর থেকে দুর্বল ও ফোঁকলা করে দিচ্ছে। পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় দেশের সম্পদ দেশে রাখতে এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে ক্রমবর্ধমান দক্ষ জনশক্তির চাহিদা পূরণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারলেই কেবল দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে।
জাতীয় অর্থনীতি বর্তমানে বৈদেশিক আয়ের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যে স্ফীতি ঘটে চলেছে তাতে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু যেভাবে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে তাতে বিশ্বে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা দিন দিন কমবে। এজন্য দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে হবে। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আর আমাদের মাদরাসাসমূহে ব্যবহারিক আরবি শিক্ষা চালু করা যায় কি-না তা ভেবে দেখতে হবে। একটু পরিকল্পনা করে এগুলে শ্রমিক রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানো সম্ভব হবে বলে আমাদের ধারণা।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jashim uddin ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১, ৫:০০ পিএম says : 0
আমি মালয়েশিয়া যেতে চাই কবে নিবন্ধন করতে হবে আমাকে বলবেন কোথায় নিবন্ধন করবো ঠিকানা দিন
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন