প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে ডলফিনের বারবার মৃত্যুর ঘটনায় এলাকাবাসীর মাঝে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। গাঙ্গেয় প্রজাতির ডলফিন এর বিচরণ রয়েছে এশিয়ার বিখ্যাত এই হালদা নদীসহ সাঙগু কর্ণফুলী নদীতে। ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী এই নদীতে ডলফিন ছিল ১৯৫টি। ২০২০ সালে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুণরায় জরিপ অনুযায়ী জানা যায়, ডলফিন রয়েছে ১২৭টি। তারমধ্যে হালদা নদী থেকে ৩৩টি মৃত ডলফিন উদ্ধার হয়েছে। এরমধ্যে ১৭টি মারা যায় আঘাতজনিত কারণে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদীতে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র কয়েকটি ডলফিন।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের এক জরিপ অনুযায়ী সারা বিশ্বে বিভিন্ন নদীতে ডলফিন ও গাঙ্গেয় ডলফিন আছে আনুমানিক ১১০০ শত। সারা বিশ্বে নদ-নদীতে ডলফিন থাকলেও তবে ডলফিন নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে হালদা নদী। তাদের জন্য নিরাপদ যথেষ্ট বলে ধারণা করা গেলেও দিন দিন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে ধারণার।
গত ২৪ শে অক্টোবর আন্তর্জাতিক মিঠাপানির ডলফিন দিবস পালন হলেও সেদিন হালদা নদী থেকে একটি মৃত্যু ডলফিন উদ্ধার করেন স্থানীয় লোকজন ও নৌ পুলিশ কর্মকর্তারা। জেলেদের জালে আটকা পড়ে একের পর এক ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে। পাশাপাশি ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলাচলের কারণে আঘাতজনিত হয়েও মারা যাচ্ছে ডলফিনগুলো। এ প্রসঙ্গে হালদা বিশেষজ্ঞরা জানান, ডলপিনের লম্বা ঠোঁট করাতের মতো দাঁত রয়েছে। সেই দাঁত নদীতে থাকা জালে আটকে যায়, আধাঘন্টার বেশি আটকে থাকলে সেই ক্ষেত্রেই শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে ডলফিন। সর্বশেষ ২৭ ডিসেম্বর উপজেলার দক্ষিণ মাদার্শা রাম দাস মুন্সির হাট এলাকা থেকে ডলফিনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। যা গত তিন মাসে ওই স্থান থেকে তিনটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে রুই কাতলা মৃগেল কালিবাউস মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। জোয়ার ভাটার এই নদী রীতি মতে প্রাচীনকাল থেকেই এই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু মা মাছ শিকার, নদী হতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন, নদীর বাঁক কাটা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই হালদা নদী থেকে মা মাছ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। দ্রুত সরকারিভাবে হালদা নদীর উপর কড়া নজর নিরাপত্তা না দিলে হালদার জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে না। তাতে একদিন এই হালদার জীববৈচিত্র্য ও মা মাছের প্রজনন বন্ধের আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে উপজেলা প্রশাসন থেকে হালদা নদীতে বারবার অভিযান পরিচালনা করে হালদা থেকে বালু উত্তোলন কিছুটা রোধ করা গেলেও, রোধ করা যাচ্ছে না অবৈধ ভাবে মাছ শিকার। মাছ শিকারে ব্যবহৃত জালে অনেক সময় ডলফিন এর মৃত্যু হচ্ছে বলেও ধারণা অনেকের। তাই মাছ শিকার বন্ধ করা না গেলে ডলফিন এর মৃত্যু বন্ধ করা যাবে না। এজন্য বাড়াতে হবে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি এবং প্রতিনিয়ত সাঁড়াশি অভিযান।
তবে সঠিক কি কারণে ডলফিন বারবার মারা যাচ্ছে এর কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বস্ত সূত্রে আরো জানা যায়, একশ্রেণির অসাধু চক্র ডলফিনের তেল সংগ্রহে নিজেরাই ডলফিনকে মেরে গায়েব করে ফেলে। ফলে ডলফিনের মৃতে্যুর হিসেবের বাইরে থেকে যায়। তাই সবাইকে নিয়ে দ্রুত সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম বা ব্যবস্থা নেয়া না হয়, তাহলে একসময় হয়তো হালদা নদীর ডলফিন শূন্য হয়ে পড়বে। ফলে জীববৈচিত্র ও ঐতিহ্য হারাবে হালদা নদী।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহিদুল আলম বলেন, এ উপজেলায় যোগদান করার পর থেকে আমি হালদা নিয়ে কাজ করছি। এ পর্যন্ত ২১ টি অভিযান পরিচালনা করে ২৮ হাজার ৫০০ মিটার ঘেরা জাল উদ্ধার করেছেন। ঘেরাজাল বসানোর কাজে ব্যবহৃত দুটি নৌকা ধ্বংস করা হয়েছে। বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত চারটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে যার মধ্যে একটি ধ্বংস করা হয়েছে। একজনকে বিনাশ্রম কারাদন্ড এর পাশাপাশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য এবং ডলফিন রক্ষায় অভিযান নিয়মিত চলবে বলেও জানান তিনি। তবে বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় হালদা নদীর নব্যতা হারাচ্ছে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে হালদা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকল্পে এবং সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন