শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

খাদ্য নিরাপত্তায় ঘাটতি

প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দেশের কৃষকরা প্রতিবছর প্রায় কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করছে। এমনকি খাদ্যশস্য বিদেশে রফতানীর কথাও সরকারের পক্ষ থেকে বেশ জোরেশোরে প্রচার করা হয়েছে। এহেন বাস্তবতার মধ্যেও দেশের ২৫ ভাগ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দিন যাপন করছে। বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির যৌথ গবেষণায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক খাদ্য নিরাপত্তার এই চিত্র বেরিয়ে এসেছে। ‘স্ট্রাটেজিক রিভিউ অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ডাব্লিউএফপি’র সর্বশেষ জরিপ রিপোর্টে বাংলাদেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ পরিমিত খাদ্য পায়না, তারা নিয়মিত খাদ্য অনিশ্চয়তায় ভোগে। এদের মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটের মধ্যে রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ডাব্লিউএফপি বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার দুর্বলতা তুলে ধরার পাশাপাশি ক্ষুধা ও পুষ্টি সমস্যাকে উন্নয়নের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করেছে। রিপোর্টটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা উপলক্ষে এনইসি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যৌথ গবেষণার সমন্বয়ক, আয়ারল্যান্ডের অলস্টার ইউনিভার্সিটির ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স বিভাগের অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেন, দেশের এক বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের মধ্যে রেখে কোন দেশই সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক লক্ষ্যের বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করতে পারেনা। সরকার যখন ২০২৪ সালের মধ্যে দেশকে ক্ষুধামুক্ত, ২০৩০ সালের মধ্যে অপুষ্টিমুক্ত এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তখন এই যৌথ গবেষণা রিপোর্টে এক হতাশাজনক চিত্র বেরিয়ে এলো।
দেশের উন্নয়ন ও ক্ষুধা-দারিদ্র্য বিমোচনের সরকারী প্রচার প্রচারণাকে কেউ কেউ রাজনৈতিক কারণে অতিপ্রচার বা প্রপাগা-া হিসেবে অভিহিত করলেও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, গত ৬-৭ বছরে দেশের উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাকবলিত জেলাগুলোতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেখানকার মঙ্গা বা তীব্র খাদ্য সংকট অনেকটাই দূর করা সম্ভব হয়েছে। তবে এ সময়ে দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তায় ঘাটতি বা বৈষম্য কতটা বেড়েছে বা কমেছে তার তুলনামূলক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে গত কয়েক বছরে তীব্র অপুষ্টির হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেনি বলেই গবেষণায় জানা গেছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ পর্যাপ্ত পুষ্টিকর ও নানা ধরনের খাবার খেতে পায়না। আর অপুষ্টির কারণে প্রতি তিনটি শিশুর একটির সঠিক শারীরিক বিকাশ ঘটেনা। মায়ের অপুষ্টি এবং অপূর্ণাঙ্গ অবস্থায় জন্মগ্রহণের কারণে প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ শিশু মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে। অপুষ্টির কারণে দেশের মানুষের উৎপাদনশীলতা কমছে, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ১০ কোটি ডলার বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও অপুষ্টি দূর করে উৎপাদনশীলতা ঠিক রাখার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বিষয়ক কৌশলগত পর্যালোচনা রিপোর্ট সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রীর গবেষণায় যে সব দিক উঠে এসেছে তা’ এসডিজি-২ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে দাবী করেছেন। দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার এই নাজুক হাল পরিবর্তন সঠিক কর্মপন্থা ও গাইডলাইন প্রণয়নে এই গবেষণা ও প্রতিবেদন সহায়ক হয়। তবে এর সার্থকতা প্রতিপন্ন হবে। ইতিমধ্যে সরকার কৃষকদের জন্য নানা ধরনের ইনসেন্টিভ ঘোষণা করেছে। মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, সহজশর্তে কৃষিঋণসহ কৃষিখাতে বছরে শত শত কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়ে দেশে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হলেও মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় গ্রামীণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টির মাত্রা কমছেনা। অর্থাৎ কৃষিখাতে সরকারের ভর্তুকি অথবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা-দারিদ্র্য বিমোচনে গৃহীত পদক্ষেপগুলো তেমন কাজে আসছেনা। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার দরিদ্র মানুষের জন্য ১০টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির যে উদ্যোগ নিয়েছে তা’ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পদক্ষেপ। এ কর্মসূচি নানা ধরনের দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও দলবাজির কারণে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছেনা। যেখানে দেশের চারকোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেখানে সীমিত আকারে স্বল্পমূল্যে চাল সরবরাহ করে এই সমস্যা নিরসন সম্ভব নয়। কৃষিব্যবস্থায় অপরিমিত রাসায়নিক সার, বহুজাতিক কোম্পানীর পেস্টিসাইড, হার্বিসাইডের অতি ব্যবহার আমাদের ভূমির উর্বরতা যেমন নষ্ট করে দিচ্ছে, নদী ও খালবিলের পানিদূষণ ও জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস করার পাশাপাশি কোটি কোটি মানুষকে নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত করছে। এসব বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগ ছাড়া সাধারণ মানুষের উৎপাদনশীলতা ঠিক রাখা যায়না। যেনতেন প্রকারে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়েই যে দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, ডাব্লিউএফপি’র স্ট্রাটেজিক রিভিউ থেকে তা’ স্পষ্ট হয়েছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ জরুরী।    

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন