শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পিতামাতার স্থান পরিবারে বৃদ্ধাশ্রমে নয়

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ | প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

সব ভালবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকে কিন্তু সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসার মধ্যে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। মহান সৃষ্টিকর্তার অপার সৌন্দর্যময় এ পৃথিবী দেখার ক্ষেত্রে যাদের অবদান, তারা হলেন আমাদের পিতামাতা। তাদের মাধ্যমেই আমাদের পৃথিবীতে আসা। শৈশব-কৈশরের অসহায়ত্বের সময় পার করে সবল-সুস্থ মানুষে রূপায়িত হওয়ার পেছনে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, তারাইতো আমাদের মা-বাবা। জীবন দিয়ে হলেও সন্তানের সুখী করতে চান মা-বাবা। শিশুর বয়স বেড়ে ওঠার পর মাতা-পিতার দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। মা তার সন্তানদের লেখাপড়ার অভ্যন্তরীণ সর্বদিকে দৃষ্টি রাখেন আর বাবা তার শিক্ষার ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ সংস্থানে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এতে তাদের যদি কিছু অসুবিধা হয়েও থাকে তবে তারা সন্তানের মুখ পানে চেয়ে হাসিমুখে তা বরণ করে নেন। সন্তান বিপদগামী হয়ে পড়ছে কি-না, আদব কায়দার বরখেলাপ করে কি-না এ সকল দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন। সন্তানের নিকট পিতামাতার চাওয়া-পাওয়া শুধু একটাই, তা হল, সু-সন্তান হয়ে পিতামাতার মুখ উজ্জল করা। যদি কোন সন্তান সুশিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয় এবং সুনাম অর্জন করতে পারে তাহলে পিতামাতার আনন্দের সীমা থাকে না। সকল পিতামাতাই চান তার সন্তান শিক্ষিত, আদর্শবান ও চরিত্রবান হয়ে সমাজে প্রশংসিত হোক। সুতরাং এমন পরম হিতৈষীর জন্যে আমাদেরও করণীয় রয়েছে।

তাদের সেবাযত্নের বিন্দুমাত্র ত্রুটি করতে নেই। পিতামাতা যেন নিজেদের উপেক্ষিত বলে মনে না করতে পারেন তার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। যাদের অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালবাসায় আমাদের জীবন সার্থক হয়েছে বৃদ্ধ বয়সে তারা কর্ম-অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখা আমাদের কর্তব্য। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে পিতামাতাকে সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার জন্য আদালতে যেতে হচ্ছে। পরিবর্তিত জীবনযাত্রার মানুষের মানসিক মূল্য এবং চিন্তা ধারার পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। তাই যৌথ পরিবারের ধারণা আজকের জীবনযাত্রার এক অবাস্তব কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানের পরিবার একক পরিবার, মা-বাবা আর তাদের এক জোড়া সন্তান। সাধারণত দেখা যায়, যৌবন প্রাপ্তির পর সন্তান-সন্ততি এক নিজস্ব মনোজগত সৃষ্টি করে নেয়। এতদিনে মানবিক সম্পর্ক অনেকটাই গতানুগতিক সৌজন্যে পরিণত হয়েছে। এমন সময় সমাজের অনেক ব্যক্তির জন্য বৃদ্ধাবস্থা হয়ে পড়ে কষ্টকর সময়। বিশেষ করে পুরুষদের থেকে নারীরাই বৃদ্ধাবস্থায় কোনো কোনো পরিবারে বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়, যা হওয়া উচিত নয়। হয়ে থাকলে তার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্চনীয়। লক্ষণীয় যে, তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত সন্তানের দ্বারা মা-বাবারা বেশি অবহেলিত। সন্তান উচ্চ শিক্ষিত, ভাল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কিন্তু পিতাকে তার ভরণপোষণ আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আবার অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়ে, অপমানের গ্লানি নিয়ে শেষ জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। বৃদ্ধাশ্রম নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা নিজ পরিবারে।

সামাজিকভাবে বাঙালিরা একসময় বৃহৎ পরিবারে বসবাস করতো। তখন বার্ধক্যে থাকা মানুষগুলো নাতি-নাতনি নিয়ে সময় কাটাতো। সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে মানুষ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী ও বৃদ্ধ স্বজনদের থেকে দূরে থাকা বা তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখাকে খুব অপরাধ বলে মনে করতো। কিন্তু আজকের সমাজে সেই সামাজিক, পারিবারিক, নৈতিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। পিতামাতাসহ সমাজের বৃদ্ধ ও প্রবীণ শ্রেণীর প্রতি দায়িত্ব পালন ও তাঁদের প্রতি গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে প্রায়ই পিতামাতার প্রতি অসদারচণের সংবাদ পরিলক্ষিত হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রবীণ মানুষই কতকগুলি মৌলিক মানবিক সমস্যার শিকার হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান, বার্ধক্যজনিত রোগ এবং যথোপযুক্ত সেবা ও চিকিৎসা সুবিধার অভাব, একাকিত্ব ও অবহেলা, বঞ্চনা এবং আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা।

প্রবীণদের দেখাশোনার ব্যাপারে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য রয়েছে এবং প্রত্যাশা থাকে যে, পরিবার ও সমাজ তাদের প্রবীণ সদস্যদের যত্ন নেবে। কিন্তু দ্রুত আর্থ-সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন, ব্যাপক দারিদ্র্য, ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব এবং অন্যান্য কারণে ঐতিহ্যবাহী যৌথ পারিবারিক ও সামাজিক দেখাশোনার পদ্ধতি ভেঙ্গে পড়েছে। শিষ্টাচার, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ যখন তলানিতে গিয়ে পৌঁছে তখন পিতামাতাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সেবাশুশ্রুষা প্রাপ্তির বদলে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হতে হয়। পৃথিবীর সকল ধর্ম গ্রন্থে পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও বাধ্যকারী নির্দেশনা আছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় বহুবার বহুভাবে মাতাপিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন ‘আপনার রব নির্দেশ দিলেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না, আর তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভালো করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তিনি মনোযোগীদের প্রতি ক্ষমাশীল’।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত’। আল্লাহপাক মাতাপিতার জন্য দোয়া করার জন্য শিক্ষা দিয়ে কোরআন শরীফে বলেছেন, ‘রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগীরা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনি আমার পিতামাতাকে এমনভাবে লালন-পালন করুন যেমনি ভাবে আমাদের পিতামাতা আমাদের লালন-পালন করেছেন। রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ীও বাবা-মাকে ভরণপোষণ দিতে সন্তান বাধ্য থাকবে। না দিলে তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো বাবা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। অবহেলিত পিতামাতার দুঃখ কষ্ট লাগব করার জন্যে সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে সরকার ২০১৩ সালে পিতামাতার ভরণপোষন আইন প্রণয়ন করে। পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তাঁর বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না।

তা ছাড়া সন্তান তাঁর মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেবেন ও পরিচর্যা করবেন। আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাদা-দাদি, নানা-নানিরও ভরণপোষণ করতে হবে। তবে বাবা যদি বেঁচে থাকেন তাহলে সন্তানকে দাদা-দাদির এবং মা বেঁচে থাকলে নানা-নানির ভরণপোষণ করতে হবে না। উক্ত আইনের ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, কোনো প্রবীণ ব্যক্তি তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনলে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদ- দেওয়া হবে। আইনে বলা হয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তাহলে তাঁরাও একই অপরাধে অপরাধী হবেন। ফলে তাঁদেরও একই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩ এর ৬ ধারা অনুযায়ী এই আইনের অপরাধসমূহ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপোষযোগ্য। ভুক্তভোগী চাইলে আপোসের মাধ্যমে মীমাংসা করতে পারবে। কোনো সন্তান যদি আইন অনুযায়ী পিতামাতা বা দাদা-দাদি অথবা নানা-নানিকে ভরণপোষণ না দেয় তবে ভুক্তভোগী অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। এই আইনের ৭ ধারার বিধানমতে, এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হবে। পরিশেষে বলব, এ অমানবিক বিষয় রোধকল্পে আইনের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। আমাদের সকলেরই পিতামাতার প্রতি কর্তব্যপরায়ন হওয়া উচিত।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন