বাংলাদেশের সমকালীন প্রেক্ষাপটে ক্যারিয়ার ভাবনা শিক্ষিত মহলে একটি অতীব আলোচিত ও চর্চিত বিষয়। সময়ের সাথে সাথে পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণ নিজেদের সন্তানদের বস্তুগত ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নকে এতদূর নিয়ে গেছেন যে, সন্তানের মুখে বোল ফোটার আগেই তারা তাদের শিশুমনে সেই স্বপ্নের আঁচড়রেখা টানার চেষ্টা করেন। তারপর শৈশবের আনন্দমুখর দিনগুলোকে জেলখানার মতো বন্দি রেখে শুরু হয় পিতা-মাতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শিশুদের উদয়াস্ত পরিশ্রমের পালা। স্কুল-মাদরাসায় বরাদ্দ সময়টুকুর পরও সকাল-দুপুর-রাত চলে প্রাইভেট পড়ার সংগ্রাম, আর কাক্সিক্ষত রেজাল্টের আশায় বন্যের মতো হন্যে হয়ে অবিরাম পথ চলা। আবার যারা উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তারাও নানান ভাবনা-চিন্তায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মেডিক্যালে পড়বে নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন পড়বে নাকি ম্যাথ- ইত্যাকার হাজারো হিসাব-নিকাশ মিলাতে গলদঘর্ম আজকের প্রজন্ম ও তাদের অভিভাবকরা। অথচ, এই সময়গুলোকে খুব কম সংখ্যকের মনেই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসার জন্ম হয়। ক্যারিয়ারই যেন সব। সফল ক্যারিয়ার বলতে কী বুঝায়? ক্যারিয়ার গঠনের উপায়ই বা কী? শুধু কাক্সিক্ষত রেজাল্ট আর প্রত্যাশিত পেশাজীবন কিংবা পদ-পদবী, অর্থবিত্ত আর সামাজিক মর্যাদা লাভই কী ক্যারিয়ার গঠনের প্যারামিটার? এই ক্যারিয়ার কি দুনিয়ার ক্ষণিকের মিছে মায়ার জগৎ ছেড়ে যাওয়ার পর কোনো কাজে আসবে? নাকি মুক্তি দেবে চিরস্থায়ী জীবনের ফলাফল নির্ধারণী সেই মহাদিবসে?
রাসূল (সা.) প্রতিদিন সকালে তিনটি বিষয়ের প্রার্থনা করে দো‘আটি পাঠ করতেন: ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে উপকারী জ্ঞান, কবুলযোগ্য আমল এবং পবিত্র রিযিক দান করুন’। এই তিনটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষ্য করলে ¯পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় যে, আমাদের ক্যারিয়ার ভাবনা তো এমনই হওয়া উচিৎ ছিল! কেননা, যে ক্যারিয়ার ভাবনা ইহকাল ও পরকাল দু’টোকেই সামনে রাখে, সেটাই তো প্রকৃত ক্যারিয়ার ভাবনা। সফল ক্যারিয়ার তো তারই যে নিজেকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের জন্যই প্রস্তুত রাখে। যদি কেউ একমুখী দুনিয়াবী ক্যারিয়ার গঠনকে গুরুত্ব দেয়, আর পরকালকে গুরুত্বহীন মনে করে, নিঃসন্দেহে তার ক্যারিয়ার গঠন পরিকল্পনা কেবল অপূর্ণাঙ্গই নয়, বরং ব্যর্থ। কেননা, ইহকালীন জীবন যত সফলই হোক না কেন, ক্বিয়ামতের ময়দানে যদি বিফল হয়, তবে সফলতার কোনই মূল্য নেই। তার বিবরণ কুরআনে এসেছে এভাবে, ‘কিন্তু যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে, হায়! আমাকে যদি দেওয়াই না হ’ত আমার আমলনামা এবং আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায়! আমার মৃত্যুই যদি আমার শেষ হ’ত! আমার ধন-স¤পদ আমার কোনো কাজেই আসল না! আমার ক্ষমতাও হারিয়ে গেছে!’ (হাক্কাহ ২৫-২৯)।
রাসূল (সা.) প্রতিদিন কী কী জিনিস চেয়েছেন এবং কেন চেয়েছেন? এগুলোই কি আমরা আমাদের ক্যারিয়ার ভাবনার বিষয়বস্তু হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?
প্রথমত: উপকারী জ্ঞান: রাসূল (সা.) যে কোনো প্রকার জ্ঞানের কথা বলেননি, বরং উপকারী জ্ঞান অর্জনের কথা বলেছেন। অর্থাৎ জ্ঞান মাত্রই যে উপকারী হবে, তা নয়। বরং এমন অনেক জ্ঞান রয়েছে, যা আমাদের হয় দুনিয়াবী দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নতুবা পরকালীন দিক থেকে। একজন মুসলমানের জন্য মুখ্য হলো পরকাল। সুতরাং জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে আমাদের পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে যে, আমাদের অর্জিত জ্ঞান কি উপকারী জ্ঞান? এই জ্ঞান কি আমাকে সত্যের পথে পরিচালিত করবে? এই জ্ঞানের মাধ্যমে কি আমি হালাল রিযিক উপার্জন করতে পারব? এই জ্ঞান কি আমার জান্নাত লাভে সহায়তা করবে? যদি জ্ঞান হয় সূদী কারবারের, যদি তা হয় অসুস্থ বিনোদনের, যদি তা হয় অন্যায়ের পথ অবলম্বনের, যদি তা হয় কুরআন ও হাদিসবিরোধী, যদি তা হয় শিরক-বিদ‘আত মিশ্রিত, তবে তা নিঃসন্দেহে অপকারী জ্ঞান। আর এই অপকারী জ্ঞান চিহ্নিত না করতে পারলে এবং তা থেকে বিরত থাকতে না পারলে আমাদের ক্যারিয়ার ভাবনা মূল্যহীন।
দ্বিতীয়ত: কবুলযোগ্য আমল: উপকারী জ্ঞান হয়তো অর্জন করা গেল, কিন্তু তা দ্বারা যে পেশা বেছে নিচ্ছি তাতে শুধু অর্থোপার্জনই মুখ্য? তাতে কি দুনিয়াবী ক্ষমতা ও পদমর্যাদাই মূল উদ্দেশ্য? মানুষের কাছে সম্মান লাভই লক্ষ্য? যদি তা-ই হয়, তবে তাতে দুনিয়াবী উপকার থাকতে পারে বটে, কিন্তু পরকালীন জীবনে তার কোনো মূল্য আল্লাহ্র কাছে নেই। কেননা, মানুষের প্রতিটি আমলই তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল। যদি নিয়ত হয় আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করা, তাঁর নৈকট্য হাছিল করা, তবেই তা আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি তা হয় দুনিয়াবী কোনো উদ্দেশ্যে, তবে তার ফলাফল দুনিয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। পরকালীন জীবনে তা কোনো উপকারে আসবে না। এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনি কী বলেন, যে ব্যক্তি ছওয়াব ও সুনামের জন্য জিহাদ করে, তার জন্য কী রয়েছে? রাসূল (সা.) বললেন, তার জন্য কিছুই নেই। সে ব্যক্তি তা তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। রাসূল (সা.) তাকে একটি কথাই বললেন, তার জন্য কিছুই নেই। তারপর তিনি বললেন, আল্লাহ বান্দার সেই আমলই কবুল করেন, যা কেবল তাঁরই জন্য একনিষ্ঠভাবে করা হয় এবং যা তাঁর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হয় না’ (নাসাঈ হা/৩১৪০, সনদ হাসান ছহীহ)।
তৃতীয়ত: পবিত্র রিযিক: ক্যারিয়ার গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে আয় বা ইনকামের সাথে। যে পেশাই হোক না কেন, পেশাটি মৌলিকভাবে হালাল কি-না তা নিশ্চিত করতে হবে। আর মৌলিকভাবে হালাল হ’লেও তাতে হারামের সংশ্রব আছে কি-না, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, জুয়া, লটারি প্রভৃতি নিষিদ্ধ বিষয়ের কোনো সম্পর্ক আছে কি-না- ইত্যাদি দিক অবশ্যই ক্যারিয়ার ভাবনার শীর্ষে থাকতে হবে। কেননা, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘ঐ দেহ কখনও জান্নাতে যাবে না, যা হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট হয়’ (বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২৭৮৭, সনদ ছহীহ)।
এখন নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তির সময়। বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে উপকারী জ্ঞান, কবুলযোগ্য আমল আর পবিত্র রিযিক- এই তিনটি মৌলিক নীতিকে সামনে রেখে যদি আমরা আমাদের সন্তানদের জীবন চলার পথ নির্ধারণ করে দিতে পারি এবং নিজেদের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে পারি, তবেই আমরা দুনিয়াবী ও পরকালীন জীবনে সফল হ’তে পারব ইনশাআল্লাহ। মনে রাখতে হবে, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন ইসলামই যদি হয় আমাদের লাইফস্টাইল এবং কুরআন ও সুন্নাহই যদি হয় আমাদের মূল গাইডলাইন, তবেই আমরা সফল। আমাদের প্রতিটি ঘর হোক জান্নাতী শোভায় সুশোভিত, প্রতিটি অন্তর হোক লোভ-লালসা, পাপ-পঙ্কিলতাহীন প্রশান্ত, সুবাসিত, আর এ লক্ষ্যেই পরিচালিত হোক আমাদের জীবন। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন।
লেখক: কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন