করোনাভাইরাস অভিশাপ না আশির্বাদ? এককথায় এই প্রাণঘাতি মহামারিকে অভিশাপ হিসেবে আখ্যায়িত করাই শ্রেয়। তবে কিছু পরিসংখ্যান সামনে আসলে বরং উল্টোই মনে হতে পারে। যেমন, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাব সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকে কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৩৯টি। গত বছরের শেষদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই তথ্য দিয়েই দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
ডিজেল ও কেরোসিনের পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি এখন ৬ ছুঁই ছুঁই, বেড়েছে দারিদ্রের হার। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মতে এই হার ২৫ শতাংশ। সংস্থাটির এক গবেষণা বলছে, করোনার কারণে দেড় কোটির বেশি মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছেন। তবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এই হার ৩৫ থেকে ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এসব তথ্য সামনে আসলে করোনাকে মহাঅভিশাপই মনে হয়। এখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পংতি ‘হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছ মহান’ উপেক্ষীত।
দেশে নি¤œ আয়ের লোকজনের দিকে তাকলে দেখা যায়, দিনের পর দিন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে তাদের। চাকরি হারানো বেশিরভাগের কপালে জুটেনি নতুন জীবিকার খোঁজ। কিছু মানুষের নতুন কর্মসংস্থান বাড়লেও আয় বাড়েনি। বিভিন্ন জরিপ বলছে, এ কারণে ৭৮ শতাংশ মানুষ খরচ কমিয়ে এনেছেন। ৫২ শতাংশ খাবার কমিয়ে দিয়েছেন। প্রায় অর্ধেক পরিবার জানিয়েছে, তারা সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছেন। প্রায় অর্ধেক শতাংশ পরিবার জানিয়েছে তাদের ঋণ বেড়েছে। প্রায় ৫ শতাংশ জানিয়েছে, সম্পদ বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার দারিদ্র্য হ্রাসের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে করোনার আগেই যারা দরিদ্র ছিলেন, তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে করোনাভাইরাস। এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে সাস্টেইনএ্যাবল ডেভলপমেন্ট গোল (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তা অর্জন করা কঠিন হয়ে যাবে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে বছর শুরু হয়। পরের ছয় মাস কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। পরের পাঁচ মাস মূল্যস্ফীতি টানা বেড়েছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত নভেম্বর মাসে গ্রামাঞ্চলে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ২০ শতাংশে উঠেছে।
একই সময়ে শহরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত মাসে গ্রামাঞ্চলের একজন মানুষ যেখানে একটি পণ্য কিনেছেন ১০৬ টাকা ২০ পয়সায়, সেখানে একই পণ্য শহরের একজন গ্রাহক কিনেছেন ১০৫ টাকা ৫৯ পয়সায়। আবার শহরাঞ্চলে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি যেখানে ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সেখানে তা গ্রামে ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। অবশ্য খাদ্যবহির্ভ‚ত মূল্যস্ফীতি গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি। নভেম্বরে শহরাঞ্চলে খাদ্যবহির্ভ‚ত মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশে উঠেছে, যা গ্রামে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। করোনার ধকল কাটিয়ে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে মানুষের হাতে টাকা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় দেশেও ডিজেল-কেরোসিনের দাম বেড়েছে। ফলে পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব পড়েছে। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। করোনার কারণে কাজ হারানো মানুষও কাজ পেতে শুরু করেছেন। এসব কারণে মূল্যস্ফীতি কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন খরচও বেড়েছে। ভাড়া যা বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি ভাড়া জোর করে নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারে চাহিদা বাড়ছে। এসব কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।
করোনা মহামারির আগে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। আর হতদরিদ্র মানুষ ছিলো সাড়ে ১০ শতাংশ। তবে করোনায় লাখ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে, এর সরকারি হিসাব এখনো দিতে পারেনি বিবিএস। তবে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মতে, করোনাভাইরাসের ধাক্কায় দেশে দারিদ্র্যের হার পাঁচ বছর আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ৩০ সেপ্টেম্বর ‘এক্সট্রিম পোভার্টি: দ্য চ্যালেঞ্জেস অব ইনক্লুশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানানো হয়, এ বছরের জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ। ২০১৬ সালেও দারিদ্র্যের হার এমনই ছিল।
তবে সানেমের জরিপ অনুযায়ী, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যতার হার বেড়ে ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালে পরিকল্পনা কমিশন ও সানেমের জরিপের ফলে এ হার ছিল ২১ দশমিক ৬০ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যতার হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ছিলো ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে বেড়ে হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪০ শতাংশ।
দরিদ্র মানুষের সব ধরনের ব্যয় করার ক্ষমতা কমেছে, তবে আয়ের সিংহভাগ খাদ্য কিনতে ব্যয় করার প্রবণতা দেখা গেছে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় নেমে আসা মানুষগুলো নিজে থেকে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
জরিপের ফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যতার হার দুই বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দারিদ্র্যতার হার গ্রামের তুলনায় বেশি বেড়েছে শহর ও মফস্বলে। এছাড়া মহামারির সময়ে সংকট মোকাবেলার দরিদ্র মানুষেরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। এর মধ্যে ৪৮ দশমিক ৭২ শতাংশ ঋণ নিয়েছেন, ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ সঞ্চয়ের ওপর নিভর্র করেছেন, ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ খাদ্য-ব্যয় কমিয়েছেন, ২৭ দশমিক ২ শতাংশ বাধ্য হয়ে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছেন এবং ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বন্ধু বা আত্মীয়দের কাছ থেকে অনুদান নিয়েছেন।
অন্যদিকে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয়েও তেমন গতি নেই। বিশাল লক্ষ্যের বিপরীতে শুল্ক-কর আদায়ে ক্রমে পিছিয়ে পড়ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আশাজাগানিয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর একের পর এক প্রতারণায় সর্বস্বান্ত হাজারও গ্রাহক। তবুও ২০২১ সালে দুই দফায় বেড়েছে মানুষের মাথাপিছু আয়। গত বছর মাথাপিছু আয় ২০২৪ ডলার চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় হয় ২ হাজার ২২৭ ডলার এবং বছর শেষে এসে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছিল। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য হলো ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৬৭ কোটি টাকা। বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন স্থায়ী খরচের বাইরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) খরচ করে। বেতন-ভাতার খরচ কমানো না গেলেও এডিপির খরচ কমানো সম্ভব।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন বেড়ে হয়েছে ১৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে পাঁচ মাসে খরচ হয়েছে ৪৪ হাজার ৬১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এই সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন