বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে। আশানুরূপ নতুন বিনিয়োগ না থাকায় অর্থনীতির গতি অনেকটাই শ্লথ হয়ে গিয়েছে। ব্যাংকে দিন দিন অলস টাকার পাহাড় জমছে। বিনিয়োগ না থাকায় এ বিপুল অংকের অর্থ পড়ে আছে। আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে প্রতি মুহূর্তে বেগ পেতে হচ্ছে। আমানত নিরুৎসাহিত করে বিনিয়োগের গতিপ্রবাহ বৃদ্ধি করার জন্য ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলো সুদের হার স্মরণকালের নিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। এমনকি শিল্পঋণের ক্ষেত্রেও সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে। তারপরও অলস টাকার কোনো গতি হচ্ছে না। বরং এর প্রতিক্রিয়া উল্টো হয়েছে। আমানতকারীরা যেখানে বেশি সুদ পাওয়া যায়, সেখানে বিনিয়োগ করছে। বিশেষ করে জাতীয় সঞ্চয়পত্র এবং বন্ডের দিকে তারা ঝুঁকেছে। এর ফলে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে জাতীয় সঞ্চয়পত্র এবং বন্ডে বিনিয়োগ বেড়েছে ৭৬.১৮ শতাংশ। ব্যাংকে সুদের হার কম হওয়ায় এই বিনিয়োগ বেড়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। ডিরেক্টরেট অফ ন্যাশনাল সেভিংস-এর ডাটা অনুযায়ী, গত বছর অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে সঞ্চয়পত্র ও বন্ডে বিনিয়োগ হয়েছিল ৬ হাজার ৬১২.৪৩ কোটি টাকা। এ বছর একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬৫০.০৭ কোটি টাকা। এ খাতে বিনিয়োগ কমাতে সরকার গত বছরের ২৩ মে সুদের হার ২ পার্সেন্ট কমিয়ে দিলেও আমানতকারীরা এদিকেই বেশি ঝুঁকছে। এর কারণ ব্যাংকগুলোর সুদের হার ফিক্সড ডিপোজিটের ক্ষেত্রে ৬ থেকে ৭ পার্সেন্ট। স্বাভাবিকভাবেই আমানতকারীরা যেখানে বেশি লাভ পাবে সেখানেই ঝুঁকবে।
ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করার চেয়ে সঞ্চয়পত্র ও বন্ডে বিনিয়োগ করার প্রবণতায় নিশ্চিতভাবেই দেশের সার্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক দিকটি ফুটে উঠেছে। অর্থ কাজে না লাগালে বা লাগানো না গেলে তা কখনোই বৃদ্ধি হয় না। অর্থের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ব্যবহার যত বৃদ্ধি পাবে, গতিও তত বৃদ্ধি পাবে। কথায় বলে, টাকায় টাকা আনে। টাকা যদি ঘরে রেখে দেয়া হয়, তবে তা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ থাকতে পারে না। অর্থনীতিও স্থবির হতে বাধ্য। বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত কয়েক বছর ধরে যে কচ্ছপ গতিতে চলছে, তা অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য ও বিভিন্ন পরিসংখ্যানে প্রায় প্রতিদিনই তুলে ধরা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, ব্যাংকগুলোর অন্যতম মূল পুঁজিই হচ্ছে আমানতকারীদের আমানত। তাই ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের কথা বলে আমানতকারীদের উৎসাহিত করে। ব্যাংকগুলো তাদের এই অর্থ নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে ব্যবসা করে আমানতকারীদের সুদ বা লাভ প্রদান করে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ব্যাংকগুলোই সুদের হার কমিয়ে আমানতকারীদের অনুৎসাহী করে তুলছে। এমনকি জমাকৃত অর্থে ভল্ট উপচে পড়লেও তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনভাতাসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে নিজেদের খরচ মেটাতে অনেকটা কারচুপির পথ অবলম্বন করতে হচ্ছে। সার্ভিস চার্জ, এসএমএস চার্জসহ নানা গোপন চার্জের নামে আমানতকারীর জমাকৃত অর্থ থেকে কেটে নিচ্ছে। আমানতকারীদের লাভ দেয়া দূরে থাক উল্টো লোকসানের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। যৌক্তিক কারণেই আমানতকারীরা লোকসান মেনে নেবে না এবং তারা যেখানে বেশি সুদে অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে, যেখানেই যাবে। সরকারি যে চারটি ব্যাংক রয়েছে সেগুলোও পুঁজি সংকটে পড়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর কারণ সরকার নিজেই এ ব্যাংকগুলো থেকে এত পরিমাণ ঋণ নিয়েছে যে এগুলো সংকটে পড়ে গেছে। সরকারের কাছে টাকা চেয়েও পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য কী দুর্দশায় নিপতিত! অর্থনীতি গতিশীল হলে নিশ্চিতভাবেই এসব নেতিবাচক দিক উঠে আসত না। এর মূল কারণই হচ্ছে, দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বিচারে বাংলাদেশ ব্যবসায়িক পরিবেশের দিক থেকে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৬ নম্বরে রয়েছে। যদিও গত বছর ছিল দুই ধাপ পিছিয়ে ১৭৮-এ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পেছনে রয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সার্বিক অর্থনীতির এই দৈন্যচিত্র বুঝতে বিশ্বব্যাংকের হিসাবের প্রয়োজন পড়ে না। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বৃহৎ ব্যবসায়ীও বোঝেন, তারা ব্যবসা করতে গিয়ে কী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। এমনকি শিল্পঋণের ক্ষেত্রে সরকার সুদের হার ১৮ পার্সেন্ট থেকে কমিয়ে ১১-১২তে নামালেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের আমানত বেড়েই চলেছে এবং তারা তারল্য সংকটকে তীব্র করে তুলছে। এখন আমানতকারীরাও ব্যাংক থেকে আশানুরূপ লাভ না পেয়ে সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক এই নেতিবাচক চিত্র সরকার স্বীকার না করলেও জানে না, এমন মনে করার কারণ নেই। এটা একটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার, কোনো সরকারই তার সময়ে দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতার কথা প্রকাশ করে না। তবে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা তো বটেই দেশের সাধারণ মানুষও অর্থনৈতিক টানাপড়েনের বিষয়টি বোঝে। এই যে, মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ ডলার থেকে এক ডলার কমে ১৪৬৫ ডলার হলো, এ থেকে কী অর্থনীতির উন্নতি বোঝায়? যেখানে বৃদ্ধি বা স্থির থাকার কথা, সেখানে তা কমে গেল। এর কারণ হচ্ছে, সত্যিকার অর্থেই দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভাল নয় এবং যতই দিন যাচ্ছে তা অবনতির দিকে ধাবিত। সরকারকে এ সত্যটি উপলব্ধি করে তা ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের মানুষ এবং সার্বিক অর্থনীতি যে চাপের মধ্যে রয়েছে, তা এখন আর কথার উন্নয়ন দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে না। বড় বড় মেগা প্রজেক্টকে উন্নয়নের লকেট হিসেবে দেখানো যেতে পারে, তবে তা দিয়ে মালা গাঁথা যাবে না। সরকারকে দেশের অর্থনীতির প্রকৃতচিত্র হৃদয়ঙ্গম করতে হবে এবং তা কাটিয়ে উঠতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকের অলস টাকা কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে পরিকল্পনা করতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন