পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা সাত হাজারের অধিক। তার মধ্যে অধিকাংশ মানুষ ২৩টি প্রধান ভাষায় কথা বলে। চীনা ভাষার অবস্থান পৃথিবীতে প্রথম। এ ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ১২৮ কোটির উপরে। চীনা ভাষা গণচীন, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রভাষা। এ ভাষাতে পৃথিবীর ৩৩টি দেশের মানুষ কথা বলে। দুই নম্বরে অবস্থান করছে স্পেনীয় ভাষা। পৃথিবীতে স্পেনীয় ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৪ কোটি। পৃথিবীর ২২টি দেশের সরকারি ভাষা হলো স্পেনীয় ভাষা। ৩১টি দেশের মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। তিন নম্বরে অবস্থান করছে ইংরেজি ভাষা। পৃথিবীতে এ ভাষাভাষি মানুষের সংখ্যা ৩৮ কোটি। ইংরেজি ভাষা পৃথিবীর মোট ১৮টি দেশের মাতৃভাষা। সর্বাধিক ১০১টি দেশের মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে। আর পৃথিবীতে আরবী ভাষার অবস্থান চতুর্থ। এ ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা ৩৫ কোটি। সর্বাধিক ২৮টি দেশের মাতৃভাষা হলো আরবী। আর দ্বিতীয় সর্বাধিক ৬০টি দেশের মানুষ আরবী ভাষায় কথা বলে। ইসলামী গবেষকদের মতে, পৃথিবীর প্রথম মানুষ ছিলেন আদম (আ.)। তার ভাষা ছিল আরবী। ইসলামে বিশ্বাসী প্রাচীন আরব মুসলিমগণ দেশ বিজয়ের পাশাপাশি ভাষাশিক্ষার বিস্তারেও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। কারণ, শিক্ষা এবং ধর্মকে তারা আলাদা করে দেখতেন না। তখন শিক্ষা এবং ধর্মকে আঙ্গাঙ্গিভাবে বিবেচনা করা হতো। তারা দেশ-বিদেশ ও মহাদেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছিল আরবী সভ্যতা। প্রাচীন সমৃদ্ধ অসংখ্য ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতা আরবী ভাষাতেই রচিত হয়েছিল। তাই বিশ্বময় আরবী ভাষার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। আরবীয় মুসলিমদের আগমনের গতিধারায় উপমহাদেশে আরবী শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন ঘটে। বাংলাসহ উপমহাদেশের প্রতিটি এলাকায় গড়ে ওঠে আরবী শিক্ষা কেন্দ্র। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ আমলে খোদ বাংলাতেই ৮০,০০০ মাদরাসা ছিল। ক্ষমতা দখল করে ব্রিটিশরা বাংলা থেকে ইসলামী সভ্যতার গতিপথ রুদ্ধ করে দিতে থাকে। ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন। তারা মুসলিমদের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মুসলিম নেতৃবৃন্দের ধারাবাহিক আন্দোলন আর অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে ২৫টি সাব কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটির মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল আরবী ও ফার্সি সাব-কমিটি। অন্যটি হলো ইসলামিক স্টাডিজ সাব-কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব আলী চৌধুরীর ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকল্পে ১৯০২ সালে তিনি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নগদ দান করেছিলেন। মুসলিম জাগরণের অন্যতম এই পথিকৃৎ ইসলামিক স্টাডিজ নামে একটি অনুষদ খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তার ক্ষমতাবলে বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কলকতা কমিশন আরবীকে ইসলামিক স্টাডিজের সাথে যুক্ত করে দেয়। যুক্ত এ আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজকে এ কমিটি একটি বিভাগে পরিণত করে। এভাবে তারা আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজকে সংকুচিত করে একটি বিভাগ খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর ফার্সিকে উর্দুর সাথে যুক্ত করে ফার্সি ও উর্দু-দুটি বিভাগকে একটি বিভাগে পরিণত করে। সংক্ষিপ্ত এ তথ্যসূত্র এটাই প্রমাণ করে যে, ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী বিভাগ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম বিভাগসমূহের অন্যতম। যে বিভাগকে অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস-চ্যান্সেলর পি, জে, হার্টগ তাই প্রথম কোড সভায় প্রদত্ত প্রথম বক্তব্যে এ বিভাগকে ‘কর্নার স্টোন’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী ভাষার উপযোগিতা ও চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ১৯৮০ সালে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ স্বতন্ত্র দুটি বিভাগে রূপান্তরিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর হতে বিভাগ দুটি দেশে শিক্ষা বিস্তারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিভাগ দুটি দেশকে অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তান উপহার দিয়েছে। শ্রেষ্ঠ এ সন্তানেরা দেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। রাজনীতিতেও তাদের অবদান স্মরণ করার মতো। এ সমস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: এস এম হুসাইন, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিচারপতি আব্দুল জব্বার খান, সাবেক স্পিকার, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। আবদুল হক ফরিদী, সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ। ড. সিরাজুল হক, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ড. এ কে এম আইয়ুব আলী, সাবেক অধ্যক্ষ, মাদ্রাসা ই আলিয়া, ঢাকা। ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী, সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, সাবেক উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও আ না ম রইছ উদ্দিন, প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর হতে প্রতিটি সরকারই এ শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর মোট সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয় ২০১০ সালে। এ শিক্ষানীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে বক্তব্য রাখেন। আর এ শিক্ষানীতির উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতি জাতীয় শিক্ষাক্রমে প্রতিফলিত হয়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২-এ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ইসলামী শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় শাখা থেকে ইসলামী শিক্ষাকে পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে। আর মানবিক শাখায় ইসলামী শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্টভাবে একথা উল্লেখ ছিল যে, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করা’। শিক্ষানীতিতে উল্লেখিত শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য জাতীয় শিক্ষাক্রমে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়ে গেল। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২তে শিক্ষানীতিতে বর্ণিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিটকে গেল। আবার প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২০তে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়া হলো। অর্থাৎ দশম শ্রেণীর বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়গুলোর বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ফলে এ বিষয়গুলোর ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত চালু থাকবে। বিষয়গুলোর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। এ মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করেই একজন শিক্ষার্থীর গ্রেড নির্ধারিত হবে। কিন্তু ইসলামী শিক্ষাকে বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে এটি গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত হলো। এ বিষয়ে গ্রেড উন্নয়নের জন্য আর কোনো ক্লাস এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। কারণ, শিক্ষার্থীরা বোর্ড পরীক্ষা ব্যতীত এটি পড়তে কখনোই আর আগ্রহী হবে না। আর শিক্ষকগণও এ বিষয়ে আর কোনো গুরুত্ব দেবেন না। শিক্ষানীতিতে ঘোষিত শিক্ষার্থীদের নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনের যে কথা বলা হয়েছে, সেটিও জাতীয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ স্কুল ও কলেজে ইসলামী শিক্ষা বিষয়ে পড়াশুনার আর কোনো সুযোগ রইল না। অন্যদিকে ঐতিহ্যবাহী আলিয়া মাদরাসার অবস্থাও ভালো না। অনাদর আর অবহেলায় আলিয়া মাদরাসা তার স্বকীয়তা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে যাও আছে তার অবস্থাও খুব একটা ভালে না। মাদরাসা থেকে আরবী বিষয়গুলোর গুরুত্ব অনেকাংশেই লোপ পেয়েছে। পূর্বে এখানে ১০০ নম্বরের ইংরেজি ও ১০০ নম্বরের বাংলা পড়ানো হতো। বর্তমানে এখানে ২০০ নম্বরের ইংরেজি ও ২০০ নম্বরের বাংলা পড়ানো হয়। অর্থাৎ বাংলা ও ইংরেজির বিষয় সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দাখিল ও আলিমের বিজ্ঞান গ্রুপে আরবী সহিত্যকে সংকুচিত করে ৫০ নম্বর করা হয়েছে। অর্থাৎ আরবী ১ম ও ২য় পত্রকে যুক্ত করে দুটো মিলিয়ে ১০০ নম্বর করা হয়েছে। আরবী শিক্ষা সংকোচন করে এখানে ব্যাপকভাবে অন্যান্য শিক্ষাকে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এতদসত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তাদের মেধাকে যথাযথ মূল্যায়ন করছেন না। রাষ্ট্রীয় প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তাদের সাথে বিমাতাসূলক আচরণ করা হচ্ছে। আলিয়া মাদরাসা হলো দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এক ইসলামী জ্ঞানকেন্দ্র। আরবী ভাষার পাশাপাশি এখানে ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ভূগোলসহ অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করা হয়। আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি আলীয়া মাদরাসাগুলোতে আরবী ভাষার বিভিন্ন বিষয়াবলির পাঠ দান করা হয়ে থাকে। আরবি, নাহু (বাগবিধি), সরফ (রূপতত্ত্ব), বালাগাত (অলঙ্কারশাস্ত্র), ফিকহ (আইনশাস্ত্র), ফালসাফাহ (দর্শন) ও সাহিত্য ছিল এ পাঠক্রমের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক কথায়, ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অনন্য সমন্বয় হচ্ছে আলিয়া মাদরাসা। কিন্তু বর্তমানে এখানে এসব বিষয় সামগ্রিকভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। অথচ, এসব আলিয়া মাদরাসা থেকে লেখাপড়া করেই শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হয়ে থাকেন।
এ আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি, জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ইসলামী শিক্ষাকে বাদ দেয়া একটি অযৌক্তিক ব্যাপার। এটা একদিকে জাতীয় শিক্ষানীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অন্যদিকে মুসলিম জীবনের কদর্য এক হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ। পাশাপাশি এটা একটি ভাষা ও ডিসিপ্লিনের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ। ধর্মীয় প্রয়োজনে মাদরাসাতে আরবী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে ধর্মীয় প্রয়োজনের বাইরেও আরবী শিক্ষার ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। অর্থনৈতিক সাফল্য, ব্যবসায় সাফল্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়করণে এ ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে রেমিট্যান্স অর্জনের ক্ষেত্রে আরবী ভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ দেশের বৈদেশিক রেমিট্যান্স অর্জনে শতকরা ৮০ ভাগই আসে আরবী ভাষাভাষী দেশ থেকে। অর্থনৈতিক এ গুরুত্ব বিবেচনা করে ভারতের মতো একটি হিন্দু প্রধান দেশে আরবী ভাষাকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়ে থাকে। আরববিশ্বে জনশক্তি রপ্তানির জন্য তাদেরকে আরবী ভাষায় দক্ষ করে তোলা হয়। একইভাবে পাকিস্তানও সেদেশের নাগরিকদের আরবী ভাষার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আরবী ভাষাকে অবহেলার কারণে সৌদি আরবে অধিকাংশ বাঙালিকে ঝাড়ুদার আর সুইপারের মতো নিম্ন পর্যায়ের কাজ করতে দেখা যায়। আরবী ভাষায় অদক্ষ হবার কারণে তারা অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের শ্রমিকের মর্যাদা পায়। অপরপক্ষে আরবীতে দক্ষ হবার কারণে ভারত এবং পাকিস্তানের শ্রমিকদের অফিসিয়াল বিভিন্ন সম্মানজনক কাজে নিয়োগ পেতে দেখা যায়। এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নাই যে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। আর এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের সাথে আরব বিশ্বের একটি যোগসূত্র সব সময় ছিল, আছে এবং থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলে মাদরাসাগুলোতে আরবী ভাষার সংকোচন ও শিক্ষানীতির লংঘন একেবারেই বেমানান। কারণ, স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে বাঙালি মুসলিম বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। তিনি তার বক্তব্যের মধ্যে ইনশাআল্লাহ বলে নিজেকে মুসলিম পরিচয় দিতেন। তিনি ইসলামের উন্নত গবেষণার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মক্তব শিক্ষাই হবে এদেশের বুনিয়াদি শিক্ষা।’ তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৩ সালে স্থাপিত হয় ইসলামি আরবী বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামের মর্মবাণী ও চেতনা প্রসারের নিমিত্তে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ১০১০টি দারুল আরকাম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ৫৬০টি মডেল মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মান প্রদান করেছেন। ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সা.)কে গেজেটভুক্ত করে জাতীয় দিবসের মর্যাদা দান করেছেন। এমতাবস্থায় স্কুল কলেজ থেকে ইসলামী শিক্ষাকে বাদ দেয়ার কোনো মানেই হয়না। দেশপ্রেমিক জনতা একে কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাবমর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করতে তারা হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে দেশবাসী মনে করে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীকে বিপদে ফেলতেই কুচক্রী মহল এ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। মহলটি এ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন পরিবেশ বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়ে দিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন পরিবেশের কথাও তারা মনে রাখছেন না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্টজনেরা এ সাবজেক্টের গুরুত্বকে অস্বীকার করে চলেছেন। তারা তৎকালীন দৃষ্টিকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলেছেন। প্রতিষ্ঠাকালীন ইতিহাস মূল্যায়ন না করেই ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ও আরবী বিভাগের প্রতি অবহেলা করেই চলেছে। এটা ধর্মপ্রাণ স্বাধীন জাতির জন্য মোটেই মানানসই নয়। বাংলাদেশের সংবিধান শুরু হয়েছে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ দিয়ে। সংবিধানের ২ এর ‘ক’ অনুসারে দেশের রাষ্ট্র ধর্ম ‘ইসলাম’। আর যে দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সে দেশে ইসলামী শিক্ষা বিষয়টিকে পাবলিক পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়া আশ্চর্যজনক স্ববিরোধিতার শামিল। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী নৈতিকতার মূল উৎস হচ্ছে ধর্ম। এমতাবস্থায় পাবলিক পরীক্ষা থেকে ইসলামী শিক্ষা বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাংলা উইকিপিডিয়া কর্তৃক ‘বিভিন্নদেশে ধর্মের গুরুত’¡ শিরোনামে একটি তথ্যনির্ভর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এখানে ‘প্রতিদিনের জীবনে ধর্মের গুরুত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৯৯% উত্তর দানকারী ইসলামী শিক্ষার পক্ষে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিয়েছেন। ধর্মপ্রাণ জনতার দাবি হলো, প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সকল শাখায় ইসলামী শিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হোক! ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়টিকে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষায় পূর্বের ন্যায় বহাল রাখা হোক! কোরআন হাদিসের ভাষা হিসেবে আরবী ভাষার মর্যাদা ফিরিয়ে আনা হোক! আরব দেশগুলোর শ্রমবাজারে শক্ত অবস্থান তৈরির সুবিধার্থে আরবী ভাষাকে বাধ্যতামূলক করা হোক! আরববিশ্বে শ্রমিক রপ্তানির নিমিত্তে আরবী ভাষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরির ব্যবস্থা করা হোক! আলিয়া মাদরাসায় আরবী সংকোচন বন্ধ করে আরবী শিক্ষাকে পূর্বের ন্যায় যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হোক! দাওরায়ে হাদিসকে শুধু মাস্টার্সের মান দিলেই হবে না, কর্ম ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ প্রদান করা হোক!
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন