মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি (উপসহকারী মন্ত্রী) লরা স্টোন বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক গভীর করার প্রতীক্ষায় আছি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রপরিচালনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবো।’ ‘নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ’ নামক একটি মর্যাদাশীল জাপানি সাময়িকীর এক প্রশ্নের জবাবে লরা স্টোন একথা বলেন। মার্কিন উপসহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইমেইলে নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ-এর জবাব দিয়েছেন।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট ফোন করেন। এই খবর বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত ও সম্প্রচারিত হয়েছিল। ঐ খবরে বলা হয়েছিল, আমেরিকা বাংলাদেশের নিকট আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছিল। ঐ সাময়িকীতে প্রতিরক্ষা সমীক্ষক এ জেড এম আনাস লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবে বাংলাদেশকে জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আমেরিকা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়ন অর্থাৎ মর্ডানাইজ করতে চায়।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ঐ রিপোর্টে বলা হয়, আমেরিকা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নিকট অত্যাধুনিক অ্যাপাচি হেলিকপ্টার, ক্ষেপণাস্ত্র এবং এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের আপগ্রেডেড ভার্সন প্রেরণ করতে পারে। ঐ জার্নালে বলা হয়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, অর্থাৎ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে বাইডেন প্রশাসন খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেই গুরুত্বারোপকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিভাষায় বলা হচ্ছে, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। সংক্ষেপে আইপিএস।
ভারত মহাসাগরীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য আমেরিকা আইপিএসকে চাঙ্গা করেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) পাল্টা সংগঠন হলো আইপিএস। বাংলাদেশ বিআরআইতে যোগ দিয়েছে। অতঃপর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকায় এসে বাংলাদেশের সরকারি খাতে ২০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে প্রাইভেট সেক্টরের যে টিম আসে তারা বাংলাদেশে আরও ১৬ বিলিয়ন ডলার বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ওয়াদা করেছে। চীন যেখানে এক সিটিংয়েই ৩৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে, সেখানে ভারত ৫০ বছরে মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলারের ওয়াদা করেছে, তাও প্রধানত সেইসব অবকাঠামোগত প্রকল্পে, যেখানে ভারতের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। এই ৫০ বছরে মার্কিন সাহায্যের সঠিক অংক পাওয়া যায়নি। তবে ইআরডি মন্ত্রণালয়ের এক অসমর্থিত তথ্য মোতাবেক, এই ৫০ বছরে দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে আমেরিকা ৭ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে।
এই পটভূমিতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক প্রাক্তন মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামান বলেন, সময় পাল্টে গেছে। এখন যে দেশ যত বেশি অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়, গ্রহীতা দেশে দাতা দেশের প্রভাব ততই বৃদ্ধি পায়। এই অর্থনৈতিক প্রভাব ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রভাবে রূপান্তরিত হয়। ঠিক এই ভয়টিই করছে আমেরিকা। ৩৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য ও বিনিয়োগের চীনা প্রতিশ্রুতি তো পরের কথা, বাংলাদেশের অনেক চলমান ও বৃহৎ প্রকল্পে বিপুল অর্থনৈতিক ও কারিগরি সাহায্যের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওপর চীনের প্রভাব কতখানি বেড়েছে সেটা সঠিকভাবে জানা না গেলেও বিপুলসংখ্যক জনগণের নিকট চীনের গ্রহণযোগ্যতা যে বেড়েছে সেটি নির্দ্বিধায় বলা যায়।
জাপান সরকারের ঘনিষ্ঠ এই ফিন্যান্সিয়াল জার্নাল নিক্কেই তাই রিপোর্ট ছেপেছে যে, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব হ্রাস এবং মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধির জন্য আমেরিকা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত করে শক্তিশালী করার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছে। উল্লেখ্য, নিক্কেই জাপানের বহুল প্রচারিত পত্রিকা। এর সার্কুলেশন ৩০ লক্ষ। ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি লরা স্টোন বলেছেন, বাংলাদেশের কাছে সামরিক সাহায্যের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কিত আলোচনা এখনো পরিপক্কতা লাভ করেনি বলে কংগ্রেসকে এখনো নোটিফাই করা হয়নি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লরা স্টোন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান এবং মালদ্বীপ ডেস্কের দেখাশোনা করেন।
সর্বাধুনিক অস্ত্র ক্রয় সম্পর্কিত বাংলাদেশ-মার্কিন আলোচনা চলমান। এটি আর কোনো গোপন ব্যাপার নয়। ইতোপূর্বে ‘ডেইলি স্টার’ এ সম্পর্কে যে রিপোর্ট করেছে, তারও শিরোনাম, Talks on for purchase of advanced arms form US. ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্টে বলা হয়, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ আমেরিকা থেকে ১১০ মিলিয়ন ডলার বা ১১ কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছে। একই সময় চীন থেকে কিনেছে ১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার বা ১৯২ কোটি ডলারের অস্ত্র। এই পরিসংখ্যান দিয়েছে স্টকহোমের আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট। আইএসপিআরের পরিচালক আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমেরিকার নিকট থেকে অস্ত্র কিনলে চীন অসন্তুষ্ট হবে কি না? তার উত্তরে আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ বলেন, ‘এটা একজনের সন্তুষ্টি বিধান এবং আরেকজনের অসন্তুষ্টির প্রশ্ন নয়।’ এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব অকস্মাৎ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এই অঞ্চলের গুরুত্ব বৈশ্বিকভাবে বৃদ্ধি করেছে। এ কারণে মার্কিন অস্ত্র ক্রয়ের সিদ্ধান্ত সঠিক।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজের’ খবরের শিরোনাম, ‘Many countries keen to sell weapons to Bangladesh.’ অর্থাৎ, ‘বাংলাদেশের নিকট অস্ত্র বিক্রয়ে বহু দেশই আগ্রহী’। যেসব দেশ সামরিক সহায়তার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, সেই সব দেশ হল ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, তুরস্ক, বেলারুশ এবং ভারত।
অধিকাংশ দেশই যেসব সমরাস্ত্র বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করেছে, সেইসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে জঙ্গি বিমান। এসব জঙ্গি বিমান মনুষ্যচালিত এবং মনুষ্যবিহীন উভয় শ্রেণীরই হতে পারে। এছাড়াও রয়েছে স্বল্প এবং মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাংক, কামান এবং রণতরী। স্থানীয় এবং বিদেশি কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, যেসব জঙ্গি বিমান বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মার্কিন ‘এফ-১৬’, ফ্রান্সের ‘রাফালে’। এছাড়াও ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ইউরোফাইটার ‘টাইফুন’। সমরাস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারে বিদেশিরা যেমন বাংলাদেশে আসছেন, তেমনি বাংলাদেশি টিমও বিদেশে যাচ্ছে। নিউএজকে এই তথ্য জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। এ সম্পর্কিত সর্বশেষ আলোচনা হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে, যুক্তরাজ্যে।
সম্প্রতি ভারত ফ্রান্স থেকে রাফালে জঙ্গি বিমান ক্রয় করেছে এবং লাদাখ সীমান্তে মোতায়েন করেছে। এই সর্বাধুনিক বিমানটি ফ্রান্স বাংলাদেশের নিকটও বিক্রি করতে চায়। দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট এই জেট জঙ্গি বিমান ডগফাইটের জন্য খুবই উপযুক্ত।
নিক্কেই জার্নালে প্রেরিত একটি ইমেইলে ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর আলী রিয়াজ বলেন, চীন ও ভারতের দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ মোটামুটি একটি ভারসাম্য রক্ষা করে চলছিল। কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির পুনরুজ্জীবন করার পর দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ এবং বাংলাদেশকে ‘উদীয়মান মিত্র’ (emerging ally) হিসেবে আমেরিকা গ্রহণ করেছে। এতদিন এসব দেশের সাথে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকা ভারতের মাধ্যমে যোগাযোগ করছিল। কিন্তু এখন সরাসরি যোগাযোগ শুরু করেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারত এতদিন আমেরিকার দক্ষিণ হস্ত ছিল। কোয়াড গঠনের পর জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া যুক্ত হওয়ায় তাদের গুরুত্বও বেড়ে যায়। কিন্তু কোয়াডকে সামরিক জোট হিসেবে প্রকাশ করা যায়নি। তাই কোনো রাখঢাক না করে অটকটঝ (অকাস) নামে সামরিক জোট গঠন করা হয়েছে। সদস্য তিন দেশ। এরা হলো, আমেরিকা, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়া। লক্ষ করার বিষয় হলো এই যে, অকাসে ভারত নাই। বিষয়টি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। রাশিয়ার সাথে ভারতের সখ্যই কি এর কারণ? দুই নৌকায় পা দেয়াই কি এর কারণ? অতঃপর বাংলাদেশ মার্কিন সম্পর্কের কী হবে? আগামী কয়েক মাসে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন