রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসিগুলোতে ভেজাল, নকল, মেয়াদউর্ত্তীণ ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রী বেড়েছে বলে ইনকিলাবের এক খবরে বলা হয়েছে। ভেজাল, নকল, মেয়াদউর্ত্তীণ ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রী এদেশে নতুন নয়। সব সময়ই ওষুধের এই দুই নম্বরী ব্যবসা এখানে চালু আছে। যখন এই অবৈধ কারবার বাড়ে, তখন সঙ্গতকারণেই উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। এ ধারণা স্বাভাবিক যে, ঢাকাতেই কেবল ভেজাল, নকল, মেয়াদউর্ত্তীণ ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রী বাড়েনি, দেশের সর্বত্রই বেড়েছে। উদ্বেগটা এ কারণেই আরো বেশি। বলা বাহুল্য, এসব ওষুধের উৎপাদন-যোগানও বেড়েছে। মানুষ আগের চেয়ে স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। করোনাকারণে ওষুধ ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। সামান্য ঠাণ্ডা, হাঁচি, সর্দি-কাশি ও জ্বরে মানুষ ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছে, ওষুধ ব্যবহার করছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে কোন্ ওষুধ নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের, তা জানা সম্ভব নয়। ফার্মেসির বিক্রয়কর্মীদেরও অনেকের এটা জানা নেই। এই সুযোগটাই ওষুধের দুই নম্বরী উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা নিচ্ছে। করোনাকালে ওষুধের ব্যবসা সবচেয়ে রমরমা হয়েছে। এ কারণে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণও বেড়েছে। এ অভিযোগ পুরানো, সাধারণ রোগের ওষুধের পাশাপাশি গুরুতর রোগব্যাধির ওষুধও ভেজাল ও নকল হচ্ছে। বিদেশ থেকে চোরাপথে আসছে নিম্নমানের ওষুধ। এ বাস্তবতায় রোগী নির্বিশেষে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। যারা ভেজাল, নকল, নিম্নমান ও মেয়াদউর্ত্তীণ ওষুধ কিনছে ও ব্যবহার করছে, তারা দু’ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথমত, তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এসব ওষুধ গ্রহণ করে অনেকের শারীরিক বিপর্যয়, এমন কি কারো কারো মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। যারা ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করছে, বাজারজাত করছে, বিক্রী করছে তারা কতটা গুরুতর অপরাধ করছে, এ থকে সেটা উপলব্ধি করা যায়।
ওষুধের পাইকারী বাজার ও ফার্মেসিগুলোতে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ প্রকাশ্যে বিক্রী হলেও সেটা দেখার যেন কেউ নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যসুরক্ষা, চিকিৎসাসুবিধা বৃদ্ধি এবং করোনামোকাবিলায় যথেষ্ট সাফল্য ও প্রশংসা লাভ করেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য তার কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য নয়। অধিদফতর, ওষুধ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অমনোযোগ এজন্য দায়ী। ওষুধের পাইকারী বাজার ও ফার্মেসিতে মাঝে-মধ্যে অভিযান পরিচালিত হয়, ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ জব্দ করা হয়, জরিমানা করা হয়। কিন্তু এ অভিযান কাক্সিক্ষত সুফল দিতে আগাগোড়াই ব্যর্থ হয়ে আসছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এরূপ অভিযান চালিয়ে ওষুধের সরবরাহকারী কিংবা বিক্রয়কর্মীকে আটক ও দোকান মালিকদের জরিমানা করে কিংবা কিছু ওষুধ জব্দ করে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ বাজারছাড়া করা যাবে না। বাজারছাড়া করতে হলে যারা উৎপাদক ও বাজারজাতকারী, তাদের কারখানা ও গুদামে হানা দিতে হবে। গ্রেফতার করতে হবে, এ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয়, এমন কারখানা কিংবা গুদামেও কখনো কখনো অভিযান পরিচালিত হতে দেখা যায়। কিন্তু এই বেআইনী ও ঘোরতর অপরাধমূলক কাজের জন্য উৎপাদক ও গুদামের মালিকের কী শাস্তি হয়, দেশের মানুষ তা জানতে পারে না। যারা মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তারা কোনোভাবেই রেহাই পেতে পারে না।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশেও ভেজাল, নকল, ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রী হতে দেখা যায় না। সে সব দেশে এধরনের ওষুধ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিক্রী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ অন্যথা করলে কঠোর শাস্তি পেতে হয়। সেখানে আইনের কঠোরতা যেমন আছে, তেমনি নজরদারি সর্বত্র বহাল আছে। শুধু তাই নয়, ওইসব দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ওষুধ বিক্রী হয় না। চিকিৎসকরাও খ্যাতিমান ওষুধ কোম্পানির ওষুধ ছাড়া নাম-অজানা বা কম-জানা ওষুধ কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন না। আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। এখানে ওষুধ বিক্রীর জন্য চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র জরুরি বলে বিবেচিত হয় না। যে কেউ যে কোনো ওষুধ কিনতে পারে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই। অভিযোগ রয়েছে, অনেক চিকিৎসক অজানা-অচেনা কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন কমিশনের কারণে। অবশ্যই একটা অপরাধতুল্য কাজ। ওষুধের মান ও কার্যকারিতা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল না হয়ে কোনো চিকিৎসকেরই কোনো ওষুধ প্রেসক্রাইব করা উচিৎ নয়। এই ঐচিত্যবোধ আমাদের সব চিকিৎসকের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। ওষুধশিল্পে বাংলাদেশের অগ্রগতি অসামান্য। আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও মানসম্পন্ন বেশ কিছু ওষুধ কোম্পানি দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব কোম্পানির ওষুধ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। এ শিল্প বিকাশের কারণে দেশ ওষুধের ক্ষেত্রে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এটা অবশ্যই আমাদের আত্মশ্লাঘার বিষয়, গৌরবের বিষয়। অত্যন্ত পরিতাপ ও দুঃখের কথা, স্বনামধন্য বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ওষুধ একটি চক্র নকল করে বাজারজাত করছে। তাদের বিখ্যাত ওষুধের নকলও ধরা পড়েছে। এটা সম্পূর্ণ নিরোধ ও রুখতে না পারলে কোম্পানিগুলোর দেশে-বিদেশে সুনাম বিপন্ন হবে, যা কোনো অজুহাতেই কাম্য হতে পারে না। আমরা আশা করতে চাই, ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে কার্যকর ও নিয়মিত অভিযানের ব্যবস্থা করা হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এমন শাস্তি নিশ্চিত করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ অপকর্ম ও অপরাধ করতে সাহস না দেখায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন